অমর একুশে

অমর একুশে



ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব উপনীত  হয় ১৯৫২ সালে। ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি ছিল পূর্ব বাংলার আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন। আর আকস্মিকভাবে ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার স্থানীয় প্রসাশনের সাহায্যে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। এর মাধ্যমে ঢাকায় যে কোন প্রকার সভা, সমাবেশ, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ, মিছিল, নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সরকারি এই ঘোষণা প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা সরকারি এই সিদ্ধান্ত কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। তারা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধাত গ্রহণ করে।

অমর একুশে

২০ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে শহীদুল্লাহ এবং ফজলুল হক হলের মধ্যবর্তী পুকুর পাড়ে ছাত্রসভা হয়। এখানে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধানÍসহ স্থির হয়, ২১ ফেব্রুয়ারি সমাবেশে সভাপতিত্ব করবেন গাজীউল হক। তিনি যদি গ্রেফÍার হন তবে এমআর আখতার মুকুল এবং তারপর কামরুদ্দিন সভাপতিত্ব করবেন। ছাত্রদের তীব্র উত্তেজনা এবং প্রস্তুতির ভেতর দিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত পেরিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি ভোর উপস্থপিত হয়। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। রাষ্টভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতারা রাত থেকে বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান করছিল। সিদ্ধান্ত অনুসারে দুজন করে লোক জমায়েত হতে হতে সভাস্থল পরিণত হয় জনসমুদ্রে। সকাল ১০ টায়  আমতলায় সভা শুরু হয়। সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ১০-১২ জনের একটি করে দল বেরিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে। প্রথমদিকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী কিছু ছাত্র  গ্রেফÍার হন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানি নিক্ষেপ করে। পুলিশের হামলায় ছাত্ররাদের একটি বড় অংশ মেডিক্যাল কলেজের কাছে সমবেত হয়। মেডিক্যালে সমবেত ছাত্রদের ওপর পুলিশ আকস্মিকভাবে গুলিবর্ষণ করে। সেদিন পুলিশের গুলিতে ভাষা শহীদ হয়েছেন আদু সালাম, আবু বরকত, রফিক উদ্দিন, আবদুল জব্বারসহ অনেকেই। ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত একটি অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন। পাকিস্তানী বর্বর গোষ্ঠীর ধর্মের দোহাই এবং সঙ্কীর্ণ আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গীকে বাংলার প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ মেনে নিতে চায়নি। তারা চায়নি মায়ের ভাষা হারাতে। ভাষা আন্দোলনে সুদূরপ্রসারী ফলাফল হচ্ছে বাঙালী জাতীয়বাদের উত্থান। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে শুধু ধর্মের বন্ধন ছাড়া বাঙালীর আর কোন বন্ধন নেই, তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে বাংলার জনগণ। ভাষা আন্দোলন বাঙালীর মধ্যে যে অধিকার চেতনা জন্ম দেয় তা যেমন ছিল ভাষা কেন্দ্রিক, তেমনি জাতিসত্তা ও ভূখন্ডভিত্তিক। এভাবেই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালী জাতীয়তাবাদের এক সুদৃঢ় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যার ফলস¦রূপ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার অভিন্ন দাবিতে একত্রিত হয়ে সেদিন আন্দোলনে যোগ দেয়। আর এই সুদৃঢ় ঐক্য পরবর্তীতে জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে।

রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ভাষা-আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং স্বধিকারের আন্দোলনে ভাষা-আন্দোলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এদেশের আপামর জনসাধারণ রাজনৈতিক স্বাধিকারের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে। বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করা ও সমুন্নত রাখা। বর্তমানে ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ এবং জাতীয় জাগরণের অনন্য প্রতীক। ভাষা শহীদের রক্তে ভেজা সিঁড়ি বেয়ে অর্জিত হয়েছে লাল সবুজের পতাকা। সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের অভ্যুদয়।


লেখক : জ্যাষ্টিন গোমেজ

Post a Comment

Previous Post Next Post