স্বপ্নচারীর জীবনে প্রবীনজনেরা
তরুণের মনোজগৎ ঘিরে রয়েছে তাদের আকাশচুম্বি স্বপ্নগুলো। তাই স্বপ্নচারীদের জীবন দর্পণে বয়োঃজেষ্ঠ্যদের সাথে সময় কাটানোর চিত্র যেন অকল্পনীয়। তরুণদের জীবনে বিচিত্রতার আয়োজনে বয়োঃজেষ্ঠ্যদের প্রতি তাদের আবেগ-অনুভূতি আজ মৃতপ্রায়। তাই সেই সকল মানুষের কথা চিন্তা এবং উপলব্ধির অবকাশ যুবসমাজে অত্যন্ত ক্ষীয়মান। বর্তমান বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি যেন তারই জানান দেয়। নিজ স্বপ্নের নৌকা ¯্রােতে ভাসাতে গিয়ে আজ তাদের জীবনবোধ থেকে হারিয়ে গেছে অস্বিত্বহীনতার কথা, অসাড় হয়ে গেছে সমস্ত অনুভূতিগুলো। সম্পর্কের বাঁধন আজ তাদের কাছে মূল্যহীন। প্রবীনদের কুচকে যাওয়া নয়নখানি আজ তরুণদের স্বপ্ন দেখার অনুপ্রেরণা যোগায় না। বয়সের ধূলো পড়া মলিন মুখের গড়নে কেউ সন্ধান করে না ফেলে আসা দিনগুলো; তাদের শুষ্ক আলিঙ্গন তরুণ জীবনে উত্তাপ ছড়ায় না। ভাঙা দাঁতের ফাঁক-ফোকর দিয়ে উচ্চারিত মৌন শব্দগুলো তাদের আর আবেগী করেনা, ছেড়া-মলিন শাড়ির আঁচলখানি দোলা দেয় না শৈশবের লুকোচুরি খেলার স্মৃতিময় জানালায়।
প্রবীনদের অক্লান্ত পরিশ্রমেরই ফল আজকের তরুণদের সম্ভাবনাময় বর্তমান। কিন্তু তাদের সেই জীবনী আজ তরুণদের কাছে সেদিনের ধূলিময় ইতিহাস ছাড়া কিছু নয়। তাই প্রবীনেরা পরিবার ও সমাজের কাছে বোঝাসম। বর্তমানে আধুনিকতার প্রলেপ দিয়ে তারা তাদের ত্যাগ-তিতীক্ষাকে ঢেকে দিতে চায়, লুকিয়ে রাখতে চায় তাদের রঙিন পর্দার আড়ালে। আজ তাদের ব্যাথায় স্বপ্নচারীরা ব্যাথিত হয় না, জল আসে না দু’চোখের কোণায়। তারা আজ নিজ স্বপ্নে অন্ধ, তারা আজ বধির; তারা শুনতে পায়না সেসব মানুষের করুণ আর্তনাদ। স্বপ্নপচারীদের চিন্তাজগতে তারা বড়ই দুর্বল, অসহায় এবং দিশেহারা।
রীতিমত বিষ্ময়কর এটাই যে, সেই মানুষেরাই ছিল গুরুজনদের পথপ্রদর্শক। একসময় ছিল যখন প্রবীনদের কদর ছিল। শোনানো লাজুক যৌবনের গল্পগুলো আজ সেকেলে হয়ে গেছে, তাই এসব গল্পগুলো তারুণ্যের মনে পোষায় না। আজকাল তারা নাকি পড়ে কিসব অদ্ভুত কল্পকাহিনীর বইসমূহ। প্রচলিত সমাজে তরুণদের হিরণ্যময় জীবনে বয়োজেষ্ঠ্যদের স্থান আলোবিহীন এক ঘরের কোণে। তারা সেই মানুষদের পিছনে সময় ব্যায় করতে নারাজ, তাই তারা আজ কথা বলে নিঃসঙ্গতার সাথে। প্রবীনেরা নিজ প্রত্যাশার বলিদান দিয়ে, উজ্জ্বল করেছে তরুণ প্রজন্মের বর্তমান ও ভবিষ্যত। তারা ছিল তরুণদের চেয়েও বড় স্বপ্নচারী। তারা স্বপ্ন দেখতে চেয়েছে তরুণ স্বপ্নচারীর চোখে, তারা নিজ জীবনের বসন্তকে বিলিয়ে গেছে তরুণদের জীবনকে রাঙাবে বলে। আজ তারা নিরব-নিস্তেজ ও অসহায়। তরুণেরা কি পারে না তাদের স্বপ্নীল জগতে এই মানুষগুলোর একটুখানি বিচরণের সুযোগ করে দিতে?
প্রজন্মের ধারাবাহিকতায়, পাল্টে গেছে মানুষের মানসিকতা। সে যুগের তরুণদের দেহে ছিল আপনত্বের ঘ্রাণ, চোখে ছিল সহ¯্র জিজ্ঞাসা। কিন্তু এ যুগের তরুণদের মন থেকে হারিয়ে গেছে প্রিয়জনের জন্য ব্যাকুলতা। এখন আছে শুধু স্বার্থপরতার গন্ধমাখা রক্ত-মাংসের শরীর। বর্তমানে তারা টাকা রোজগারের মাত্রায় প্রবীনদের গুরুত¦ মূল্যায়ন করে¡। এত অপমান এবং অবহেলা সত্ত্বেও তরুণদের প্রতি প্রবীনদের ভালবাসা ক্ষনিকের জন্য কম হয় না। তারা তরুণদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, না বলা কথার ঝুলি নিয়ে।
শৈশব থেকে বৃদ্ধ বয়স একটি চিরন্তন চক্রাকার অগ্রযাত্রা। তরুণেরাও সেই পথেরই সহযাত্রী। জীবনের পড়ন্তবেলায় তারাও দু’চোখ ভরা জিজ্ঞাসা নিয়ে খুঁজবে আপনজনকে। হয়ত প্রবীনদেরই অনুরূপ তারাও হাজার বছরের নিঃসঙ্গতা নিয়ে বসত করবে। সেদিনও তাদের দুচোখ জুড়ে থাকবে অজ¯্র স্বপ্ন, হয়ত সন্ধান পাবে না শুধু কাক্সিক্ষত স্বপ্নচারীর।
লেখক: জাসিন্তা আরেং
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
Tags:
প্রবীণ সমাচার