শিশুর জন্য ভালবাসা


দক্ষিণ এশিয়ায় একসময় দাসপ্রথা এবং গৃহদাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। আর বর্তমানে দাসপ্রথা উঠে গেলেও গৃহশ্রমিকদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তা দাসপ্রথার বর্বরতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। জানা যায়, আমাদের দেশে ২০ লক্ষাধিক গৃহকর্মী রয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশেরই জীবন আজ অরক্ষিত ও বিপন্ন। আর এই ব্যাপারে আমাদের সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যার ফলে, আজকাল গৃহকর্মীদের শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গিয়েছে উদ্বেগজনকভাবে। গৃহকর্মী নির্যাতন ও তাদের অধিকারকে অবজ্ঞা করা এখন এক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদী বা আধা সামন্তবাদি সমাজে এটির রূপ অনেকটাই প্রকট, অথচ আধুনিক বিশে^ তাদের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। উন্নত বিশে^ তাদের বেতনভুক্ত স্টাফের মর্যাদা দেয়া হয়ে থাকে।   
শিশুর জন্য ভালবাসা

অভাব অনটনের কারণেই শৈশবে গ্রাম থেকে শহরে এসে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ নেয় বাংলাদেশের অনেক শিশু। আর এরা স্কুলে যেতে পারে না। বাবা-মাসহ পরিবারের সাথে থাকতে পারে না। এবং এই গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বাড়ির মালিকদের হাতে হারহামেশাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা- ২০১৫ অনুমোদন দিয়েছে সরকার। যেখানে বলা হয়েছে, প্রত্যেক গৃহকর্মীর কর্মঘন্টা এমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে যাতে পর্যাপ্ত ঘুম, বিশ্রাম, চিত্তবিনোদন ও প্রয়োজনীয় ছুটির সুযোগ পান। পরসংবাদ, গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালায় ওই সুযোগ সুবিধাসহ আরও যেসব সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছে, তার অধিকাংশই পান না গৃহকর্মীরা। কখনো ধারালো চাকু দিয়ে কেটে, কখনো বা গরম ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাঁকা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করছে শরীর। সুযোগ সুবিধার পরিবর্তে গৃহকর্মীদের ভাগ্যে জোটে অমানবিক নির্যাতন। অনেক গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েও কাজ করেন অভাবের কারণে। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত পরিবারগুলোয় সাধারণত যে শিশু বা কিশোর বয়সী গৃহকর্মী দেখা যায়, মূলত তারা অভাবের তাড়নায় ও জীবিকার তাগিদে গ্রামে আসে। টাকার বিনিময়ে মূলত এরা শ্রম দিয়ে থাকে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, পারিশ্রমিকের সঙ্গে জুটে যায় অনেক প্রকারের নির্যাতন। দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি ধর্ষণসহ বিভিন্ন রকম যৌন হয়রানির শিকার হয় মেয়ে কিশোরী গৃকর্মীরা। এমনকি নির্যাতনে গৃহকর্মীর মৃত্যুও নতুন কোন বিষয় নয়। আর এগুলো হচ্ছে হারহামেশাই। মূলত এরা সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির বলে এরা তেমন কোন কিছু করতে পারে না। তাই তো নিয়োগকর্তার প্রভাব ও অর্থের জোরে হত্যা হয়ে যায় একটি শিশুর গল্প। টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায় অকৃত্রিম চোখের পানি। 

যারা এধরনের অমানবিকতার কাজ করে তাদের অধিকাংশই সমাজের খুব উঁচু-উঁচু পদের আসীন। সমাজে তাদের অনেক নাম ডাক রয়েছে। সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা পর্যন্ত কেউ বাদ নেই এই তালিকায়। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেঁচে যান এসব বিকৃত মননের বিত্তশালীরা। কিন্তু প্রান্তির শ্রেনী থেকে আসা এই অসহায় গৃহকর্মীরা অনেকেই হারিয়ে ফেলে চোখ। কেউ আগুনের লেলিহান শিখায় হাত বা পায়ের কিছু অংশ চিরতরে হারিয়ে ফেলে। কারো বা পিঠে জ¦লন্ত লোহার ছ্যাঁক দিয়ে দাগ বসিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনার পর ঘটনা ঘটে যায় কিন্তু শেষ হয় না এই মানুষরূপি অমানুষদের পাশবিকতার দৃশ্য। এতসব ঘটনা দেখতে-দেখতে সুশীল সমাজ বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কতটা ঘটনার প্রতিবাদ করা যায়! আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা বলা মুশকিল। পরম দয়ার আধার বলে আমরা যে নারীকুলকে পরিচয় দিয়ে থাকি সেসব নারীর হাতেই ইদানিং অমানবিক অত্যাচারের শিকার হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত এসব গৃহকর্মী শিশু। এই বয়সে যাদের কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা সেই শিশুরাই আজ গৃহকর্মে নিযুক্ত হয়ে চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। 

সামান্য অনুভুতি সম্পন্ন ব্যাক্তির কাছেও এইসব নির্যাতন মানবতার চরম লঙ্ঘন। আইনের চোখে তো অবশ্যই দ-নীয় অপরাধ। এই অবক্ষয়ের হাত থেকে অচিরেই আমাদের সমাজকে উদ্ধার করা না গেলে জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কল্পনা করতেও কষ্ট লাগে। গৃহকর্মী নির্যাতন মানবতার অপমানেরই নামান্তর। একজন দরিদ্র অসহায় মানুষকে যে নির্যাতন করে, সে মানুষ নামের অযোগ্য। সে গোটা মানব সমাজকে কলুষিত করছে। অপরাধীর শাস্তি না হলে সে অপরাধের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। তাই সমাজের এই অসঙ্গতি দূর করতে হলে গৃহকর্মীদের সর্বপ্রকার আইনি সুরক্ষা দেয়া একান্ত প্রয়োজন। আইনের সঠিক প্রয়োগই কমাতে পারে গৃহকর্মী নির্যাতনের মাত্রা। আর সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে মানবিকতার উন্মেষ ঘটিয়ে গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষায় স্বয়ং নিয়োগদাতাকেই বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। 
  লেখক : জ্যাষ্টিন গোমেজ

Post a Comment

Previous Post Next Post