বড়দিন বয়ে আনুক মিলন ও বিশ্বশান্তি

২৫ ডিসেম্বর, বিশ্বব্যাপী খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা পালন করছেন বড়দিন। বড়দিন হলো যিশু খ্রিস্টের শুভ জন্মদিন। বড়দিন ধর্মীয় উৎসব হলেও দিনটি পালিত হয় আনন্দ সহভাগিতার মধ্যদিয়ে। পরিবারের সবাই একত্র হন, আনন্দ ভাগাভাগি করেন। একে অপরকে উপহার প্রদান করেন। ২৫ ডিসেম্বরের এইদিন সারাবিশ্বের খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য সবচেয়ে বড় এবং তাৎপর্যমন্ডিত একটি উৎসব। এইদিনে বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক খ্রিস্টানগণ একযোগে উৎসব করে থাকে। কারণ, এইদিনে মানবের পরিত্রাতা যিশু খ্রিস্ট জন্মগ্রহণ করেছেন মানুষের পরিত্রাণের জন্য। আমাদের পাপের বন্ধন থেকে মুক্ত করতে।

 

আরো পড়ুন: কবরে নাইরে যিশু ..


পবিত্র বাইবেলে বর্ণিত, যিশুর জন্মের বহুবছর পূর্বে প্রবক্তা ইসাইয়া বলেছিলেন, ‘তাই প্রভু নিজেই তোমাদের একটি চিহ্ন দেবেন। দেখ, যুবতীটি গর্ভবতী হয়ে পুত্র সন্তান প্রসব করবে, তার নাম রাখবে ইম্মানুয়েল’ (ইসাইয়া :১৪) এই বাণী নবসন্ধিতে যিশুতে পূর্ণতা পায়, ‘যিশুর জন্য এভাবে হয়। তার মা মারিয়া যোসেফের প্রতি বাগদত্তা হলে তারা একসঙ্গে থাকার আগে দেখা গেল, তিনি গর্ভবতী-পবিত্র আত্মার প্রভাবে’ (মথি :১৮, ২২-২৩) যিশুর জন্মের মধ্যদিয়ে প্রতিশ্রুত মুক্তিদাতার আগমন ঘটে, যিনি মানুষকে পাপ থেকে মুক্ত করবেন। খ্রিস্ট যিশু বেথলেহেমের নগরীতে এক গোশালায় জন্ম গ্রহণ করেন। আকারে প্রকারে মানুষ হলেও তিনি হলেন ঈশ্বরপুত্র। 

এই বিশ্বাস নিয়ে খ্রিস্ট-বিশ্বাসীরা প্রতিবছর পালন করে আসছে যিশু খ্রিস্টের জন্মোৎসব।


এই বিশ্বাস নিয়ে খ্রিস্ট-বিশ্বাসীরা প্রতিবছর পালন করে আসছে যিশু খ্রিস্টের জন্মোৎসব। যিশু খ্রিস্টের জন্ম হয়েছে পবিত্র আত্মার প্রভাবে কুমারী মারিয়ার গর্ভে। আর ধর্মীয় এই নিগূঢ়তত্ত্ব আরও বেশি করে অনুধ্যান করতে বড়দিনের সপ্তাহ আগে সকল খ্রিস্ট-ভক্তগণ আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি নেন। এই সপ্তাহকে বলা হয়আগমনকালআগমনকালেখ্রিস্টধর্মের প্রত্যেকে আধ্যাত্মিকভাবে ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। এই প্রস্তুতি যিশুকে নিজের মধ্যে ধারণ করার প্রস্তুতি। যিশুকে নিজের মধ্যে ধারণ করার অর্থ হলো তার বাণী আদর্শ নিজের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা। এই সময় বিশেষভাবে ধ্যান করা হয়ঈশ্বর মানবজাতিকে ভালোবেসে যিশু খ্রিস্টকে জগতে পাঠিয়েছেন। আর এর মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের এক অনবদ্য আত্মিক শক্তি স্থাপিত হয়েছে।

 

বড়দিনের সর্বজনীন মূল বাণী হলো ভালোবাসা, শান্তি সহমর্মিতা। এই শান্তি, ভালোবাসা সহমর্মিতা উদ্বুদ্ধ করে একে অপরের সঙ্গে সহভাগিতা করতে। সবাইকে এক করে, যাতে পরস্পরের মধ্যে ঐক্য স্থাপিত হয়। এর মধ্য দিয়ে যাতে মানবতা দিকে দিকে উদ্ভাসিত হয়। আমাদের আরও শিক্ষা দেয় উদার হতে। ঈশ্বর যেভাবে নিজে উদার হয়ে মানবের জন্য নিজের পুত্রকে জগতে পাঠিয়েছেন, সেভাবে আমরা যেন সেই উদারতার শিক্ষা গ্রহণ করি আর অন্যকে দেওয়ার মনোভাব তৈরি করতে পারি নিজের মধ্যে। সেই সঙ্গে অন্যকে ক্ষমা করার যে শিক্ষা বড়দিন আমাদের দিচ্ছে, তা যাতে আমরা আমাদের নিজের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সমাজ জাতীয় জীবনে প্রয়োগ করি।

 

আরো পড়ুন: মা মারীয়ার জন্ম উৎসব


বিভিন্ন কৃষ্টি-সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে ভরপুর বাংলাদেশে বড়দিন উৎসব ধর্মীয় উৎসবে সীমাবদ্ধ নয়। পরিণত হয়েছে কৃষ্টি সংস্কৃতির মিলন উৎসবে। এই মিলন উৎসবে ভালোবাসা আনন্দের ভাগাভাগি হয়, যা বড়দিনের মূল বার্তা। পরস্পরের সঙ্গে ভালোবাসা শুভেচ্ছা ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে বড়দিনের আনন্দ আরও বেশি সর্বজনীন হয়। বাংলাদেশে বড়দিন উদ্্যাপিত হয় এক অসাধারণ পরিবেশে। এমনিতেই বাংলাদেশ বিভিন্ন কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে ভরপুর। তার ওপর বাংলাদেশে যে সংখ্যক খ্রিস্টধর্মাবলম্বী রয়েছেন, সেখানেও আছেন বাঙালি ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী। এক-এক জাতি এক-এক ভাবে বড়দিন উদ্যাপন করে, যদিও মূল অনুষ্ঠান অভিন্ন থাকে। দেশের এই বিভিন্ন বৈচিত্র্য বড়দিনকে আরও সুন্দর করে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়গুলো একত্রিত হয়ে ঐক্যের একটি সুরেলা উদ্যাপন করে থাকে। এর মধ্য দিয়েই প্রস্ফুটিত হয় বড়দিনের মিলন সমাজ।

 

অন্যান্য বারের চেয়ে এবারের বড়দিন সত্যিকার অর্থে ভিন্ন এক মাত্রা পেয়েছে। কেননা, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দেশের জনগণের মধ্যে এক ধরনের ভোট উৎসব বিরাজ করছে। সর্বত্রই নির্বাচনী প্রচারণার আমেজ। যদিও একদল দেশবিরোধী, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিশ্বাসী তারা আগের মতো অরাজকতা তৈরি করে যাচ্ছে। তাই এবারের বড়দিন জাতীয় নির্বাচনে একতা, আশা ইতিবাচক একটি বাণী বয়ে আনুক। বড়দিন যেভাবে আমাদের প্রত্যেককে একত্রিত করে, সেভাবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সবাইকে একত্রিত করুক। প্রত্যেক দল একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়ে কাজ করুন। ভোটাররা একত্রিত হয়ে যা কিছু ভালো তা নির্বাচন করুন।

  

বড়দিনের একতার শক্তি জাতীয় একতায় পরিণত হোক। সর্বজনীন যে ভালোবাসা তা ছড়িয়ে পড়ুক রাজনীতিতে। যারাই নির্বাচিত হোক তারা যেন সেই ভালোবাসা গণমানুষের উপকারে নিজেদের নিবেদিত করতে পারেন। নেতা হয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি সেবার আদর্শও যাতে তারা স্থাপন করতে পারেন। আমাদের এবারের আশা, বাংলাদেশের সকল সংকট-সমস্যা দূর হোক। প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে সুনাগরিকের গুণাবলির বিস্তার ঘটুক। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হোক। বড়দিনের সম্প্রীতি, পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা এবং ইতিবাচক সম্পৃক্ততার পরিবেশ তৈরি হোক।

 

বড়দিনের আশীর্বাদ সারাবিশ্বে চলমান যুদ্ধবিগ্রহ অশান্তি বন্ধ হোক। সর্বত্র বিরাজ করুক শান্তি। বড়দিনের শিক্ষা যেভাবে আমাদের সহানুভূতির জোড় দেয়, সেভাবে সারাবিশ্বও যেন একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারে। প্রভু যিশুর শিখিয়ে যাওয়া ক্ষমার আদর্শ যেন বৃষ্টির মতো ঝড়ে পড়ে প্রত্যেকে যেন একে অপরকে ক্ষমার আলিঙ্গনে এগিয়ে এসে যুদ্ধ বন্ধ করে দেয়। আমরা কেউ চাই না যুদ্ধ-বিগ্রহে বিশ্বে অশান্তি তৈরি হোক। ক্যাথলিকম-লীর পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস বারবার হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।

 

আরো পড়ুন: বড়দিন বয়ে আনুক মিলন ও বিশ্বশান্তি


বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি গির্জায় একযোগে বিশ্ব শান্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে, যাতে করে বিশ্ব শান্তি-দাতা যিশু খ্রিস্ট শান্তি বর্ষণ করেন। এক পক্ষ, অন্য পক্ষকে শত্রু মনে করে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলে মানবতার ক্ষতি হয়। বড়দিনের উদারতার শিক্ষা মানুষের প্রতি মানুষের মানবতাবোধ আরও বৃদ্ধি করুক। আন্তঃধর্মীয় আলোচনা করে হলেও বন্ধ হোক বিশ্ব সংঘাত। এতে করে তৈরি হোক শান্তির বন্ধন। এসবই যখন নিশ্চিত হবে, তখন বিশ্ব থেকে কলহ দ্বন্দ্ব দূরীভূত হয়ে যাবে।


বড়দিনের শান্তি ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকুক। বড়দিনের সর্বজনীন শিক্ষা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করে নতুন বছরের সূচনা শুভ হোক। প্রভু যিশুর জন্মোৎসব পালনের জন্য আসুন আমরা মিলন-সমাজ গড়ে তুলি। ঈশ্বর মানুষের সঙ্গে মিলনের উদ্দেশে আরও গভীরভাবে জীবন-সাধনা করি। গণমঙ্গল প্রতিষ্ঠায় প্রভু যিশুর জন্ম নিয়ে আসুক সকলের মধ্যে সম্প্রীতি, শান্তি, মিলন আনন্দ। যিশু খ্রিস্টের জন্মদিনে সকলের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা। শুভ বড়দিন।


লেখক : জ্যাষ্টিন গোমেজ

সাংবাদিক

 justingomes80@gmail.com



[জীবন ও সমাজে- পাঠাতে পারেন আপনারও বস্তুনিষ্ঠ লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ] 

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post