নববর্ষ বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য

সম্পাদকীয় ডেক্স : বাংলার ঐতিহ্যকে যে সকল উৎসব অনুষ্ঠান ধারণ করে আছে সে গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ। সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাঙালিরা পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ হিসেবে পালন করে আসছে। নববর্ষ বাঙালির সহ¯্র বৎসরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রীতিনীতি, প্রর্থনা, আচার-অনুষ্ঠান, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের কাছে একটি প্রাণের উৎসব। বাঙালিরা এই দিনে পুরানো বছরের ব্যর্থতা, ব্যথা, নৈরাশ্য, গ্লানি ভুলে গিয়ে নতুন বছরকে মহানন্দে বরণ করে নেয়, সমৃদ্ধি ও সুখময় জীবনের প্রত্যাশায়। এই দিনকে বলা হয় বাঙালির জীবনের নব রবির কিরণ। দিনটিতে বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন অংশে যেমন পশ্চিমবঙ্গে, আসাম, উড়িষ্যা, মনিপুর ও ত্রিপুরায় মহাসমারোহে সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়। নববর্ষ বাংলা নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে বাঙ্গালিরা পালন করে থাকে, কিন্তু বর্তমানে তা সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এখন দেশের বাইরে ও অনেক জায়গায় প্রবাসী বাঙালিদের জন্য নববর্ষের দিন বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তবে অতীতে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ ‘ঋতুধর্মী উৎসব’ হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। নববর্ষের প্রথম দিন বদলে যায় ঢাকা, বদলে যায় দেশ। শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলায় বর্ণবহুল হয়ে ওঠে। কাক-ডাকা ভোর থেকেই বাঙালি সংস্কৃতি লালনকারী আনন্দ-পিয়াসীরা পথে নামে। কায়মনে বাঙালি হয়ে ওঠার বাসনা জেগে ওঠে সবার মনে। বর্ণাঢ্য উৎসবের রঙে রেঙে ওঠার দিনটি প্রাণে প্রাণে প্রবাহ জোগায়। 

আমাদের দেশের মতো বিশ্বের নানা দেশে বর্ষবরণের রেওয়াজ প্রচলিত আছে। তবে বিবর্তনের ধারায় আমাদের দেশের সংস্কৃতি মিশ্র-সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হলেও বাঙালির নিজস্বতা একেবারে বিলীন হয়নি। দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মিশেল ঘটেছে মাত্র। তবে বৈশাখ বা নববর্ষ পালনের যে চাকচিক্য তাতে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির মিল খুঁজে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। পাশ্চাত্যের বর্ষবরণের আদলে আমাদের দেশেও বর্তমানে কার্ডের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন, সংগীত-নৃত্যের মাধ্যমে প্রাণে গতি সঞ্চার এবং সর্বশেষ ফোন সংস্কৃতির মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ এ ক্ষেত্রে নবতর ধারার সূচনা করেছে। 

বৈশাখের পৌরাণিক দিকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ‘মাস হিসেবে বৈশাখের একটা স্বতন্ত্র পরিচয় আছে, যা প্রকৃতিতে ও মানবজীবনে প্রত্যক্ষ করা যায়। খররৌদ্র, দাবদাহ, ধূ-ধূ মাঠ, জলাভাব, কালবৈশাখীর ঝড়, ঝরাপাতা, গাছে গাছে নতুন পাতার আবির্ভাব, আমের কলি ইত্যাদি প্রকৃতি-পরিবেশের রূপ-রূপান্তরের সঙ্গে বাংলার মানুষের মন-প্রাণ-আত্মার যোগ আছে।’ ফলে তৎকালীন সমাজে বৈশাখের প্রথম দিনটির জন্য কৃষিজীবীদের অন্যরকম অপেক্ষা কাজ করতো। এই দিনটি আসার আগেই ঘর-বাড়ি পরিচ্ছন্ন করা, ব্যবহৃত তৈজসপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবসা ক্ষেত্র ধোয়া মোছা করা হতো। এ কাজগুলোর মধ্যে সামাজিক সফলতা নিহিত থাকতো। গোটা বছরটি ভালোভাবে অতিবাহিত হওয়ার বিশ্বাস থেকে প্রতিটি পরিবার এ দিনটিকে যথাসাধ্য আড়ম্বরের সঙ্গে পালন করতো। সৌভাগ্যের সূচক-বড়োসড়ো মাছ, মিষ্টির হাড়ি আসতো ঘরে। গতদিন অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির দিনে তৈলবিহীন নিরামিষ ব্যঞ্জন রান্না করার রীতি ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের। পরদিন সমারোহে মাছ খাওয়ার সঙ্গতি বাঁচিয়ে রাখার কথা বিবেচনা করেই।

পহেলা বৈশাখ, যার সঙ্গে মিশে আছে বাঙালীর ঐতিহ্য। নববর্ষকে ঘিরে সবার থাকে নানা স্বপ্ন আর বাহারি পরিকল্পনা। নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়ে রঙিন ও বর্ণিল হয়ে বাঙালি বরণ করে নেয় নতুন বছরকে। তারই প্রস্তুতি চলছে বাংলার সর্বত্র। নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ, বৈশাখী মেলা এগুলো যেন বাঙালি ঐতিহ্যের একই সুতায় গাঁথা সংস্কৃতি। বাঙালির এই ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ঐতিহাসিক শিকড় আমরা মোগল আমল থেকেই পেয়েছি। কৃষক শ্রেণীর সেই ফসলি সন এখন বাঙালি সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। কৃষকরা পহেলা বৈশাখের আগে তাদের সব হিসাব চুকিয়ে পুরনো বছরের সব গ্লানিকে মুছে ফেলে নব উদ্যমে বছরটি শুরু করতে সদা তৎপর থাকত। সব ধরনের ব্যবসায়িক মালিকশ্রেণী এবং ভোক্তাশ্রেণীর মধ্যে লেনদেনের সমাপ্তি টানা হতো পহেলা বৈশাখের আগেই। আর পহেলা বৈশাখে হালখাতার মাধ্যমে নতুনভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু হয়। বঙ্গাব্দের আগমনে বাঙালি আনন্দের জোয়ারে ভাসে। রমনার বটমূল বৈশাখী আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দুতে রূপ নেয়। কিন্তু এই বৈশাখীর রঙ লাগে গোটা দেশে, গোটা বিশ্বের আনাচে-কানাচে যেখানে বাঙালি বসত করে। নববর্ষের রঙের ঢেউ তাই এখনও বিশ্বের আনাচে-কানাচে খেলা করছে। আজও দেশ-বিদেশে যেখানে বাঙালি আছে সেখানে এই চিরায়ত রূপ ধারণ করছে আর বিশ্বব্যাপী জানান দিচ্ছে এক অনন্য নববর্ষ পালনের সংস্কৃতি চর্চার রীতি। আবহমান বাংলার চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনার মূলে রয়েছে বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বাংলা বর্ষ-বিদায় ও বরণের অনুষ্ঠানমালা সেই ঐতিহাসিক চেতনাকে প্রোজ্জ্বল করে। স্বদেশ মানস রচনায় বাঙালি সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য সর্বোপরী ইতিহাসের আলোকে রক্ষণশীল ও পশ্চাৎপদ চিন্তা-চেতনাকে পরিহার করে আধুনিক জাতিসত্তাকে যথাযথ প্রতিভাতকরার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি বাংলা নববর্ষকে দান করেছে অনবদ্য মাঙ্গলিক যাত্রাপথ। তবে বাঙালির নববর্ষ সব বাঙালির কাছে একভাবে আসেনি। কারো কাছে এসেছে খরা হয়ে, কারো কাছে খাজনা দেওয়ার সময় হিসেবে, কারো কাছে বকেয়া আদায়ের হালখাতা হিসেবে, কারো কাছে মহাজনের সুদরূপে আবার কারো কাছে এসেছে উৎসব হিসেবে।

পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ও মঙ্গল কামনায় শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রধান শোভাযাত্রাটি বের হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে শোভাযাত্রা বের করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় তুলে ধরা হয় বাঙালি সংস্কৃতির নানা দিক। ফুটিয়ে তোলা হয় চিত্র, মুখোশ আর নানা প্রতীকে। প্রতি বছরই এই মঙ্গল শোভাযাত্রার একটি মূলভাব থাকে। সেই মূলভাব প্রতিবাদ এবং দ্রোহের। সেখানে অশুভের বিনাশ কামনা করা হয়। আহ্বান করা হয় সত্য এবং সুন্দরের। 

বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদন-ক্রমে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে। ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে তাদের ‘রিপ্রেজেনটেটিভ লিস্ট অব ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর ফলে পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রা। এখন এটি বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ। বাঙ্গালী সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে স্বীকৃতি দেওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, এটা শুধু একটা সম্প্রদায় বিশেষের নয়, এটা গোটা দেশের মানুষের, সারা পৃথিবীর মানুষের।

গ্রীষ্মের এই তাপস নিশ্বাস বায়ে পুরোনো বছরের সব নিস্ফল সঞ্চয় নিয়ে যায়, দূরে যায়, দূর-দিগন্তে মিলায়। বর্ষ বরণের উৎসবের আমেজে মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। গ্রীষ্মের অগ্নিজিহ্বা হয়তো বাতাসে লকলক করে উঠবে গেয়ে। উগড়ে দেবে বাংলার ভূ-প্রকৃতিতে অগ্নিবরণ নাগ-নাগিনীপুঞ্জ ও তাদের সঞ্চিত বিষ। তারপরও বাঙালি এই খরতাপ উপেক্ষা করে মিলিত হয় তার সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক উৎসবে। দেশের প্রতিটি পথে-ঘাটে, মাঠে-মেলায় অনুষ্ঠান জুড়ে থাকে কোটি মানুষের প্রাণের চাঞ্চল্য, আর উৎসবমুখরতার বিহ্বলতা। কারণ বৈশাখ মানেই বাঙালির আনন্দের দিন।



বাংলা নববর্ষে মহামিলনের এ আনন্দ উৎসবই বাঙালিকে ধর্মান্ধ অপশক্তির কূট ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করার আর কুসংস্কার ও কূপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার অনুপ্রেরণা দেয়। সেই সঙ্গে করে ঐক্যবদ্ধ। নতুন বছর মানেই এক নতুন সম্ভাবনা, নতুন আশায় পথচলা। তাই তো বৈশাখ কেবল আনন্দের নয়, প্রতিবাদেরও মাস। বৈশাখ অপশক্তিকে রুখে দাঁড়াবার শক্তি জোগায়। তাই বাংলা নববর্ষ যেন সব কিছুর নিরাপত্তা বিধান করে বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। এটাই হোক এবারের প্রত্যাশা। আশা করি এবার আবার স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ লাভ করবে বাঙালি। নববর্ষ তার জীবন থেকে ভয়, দুশ্চিন্তা, অপমান মুছে দেবে। তাকে আবার জাগিয়ে তুলবে নতুন ভাবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করে নববর্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ও সাংস্কৃতিক সৌধের ভিত আরও সুদৃঢ় করুক, নববর্ষের উদার আলোয় ও মঙ্গলবার্তায় জাতির ভাগ্যাকাশের সব অন্ধকার দূরীভূত হোক, সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটুক, একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, এটাই হোক এবারের বাংলা নববর্ষ-এর প্রত্যয়। সকলকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। 


[জীবন ও সমাজে- পাঠাতে পারেন আপনারও বস্তুনিষ্ঠ লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ] 



Post a Comment

Previous Post Next Post