স্বীকারোক্তি

প্রিয়াংসুকে কারোরই মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়। কারণটা হয়তো তেমন একটা নেইও। মানুষ হিসাবে মানুষের মনে কেউ-কেউ গভীর দাগ কাটতে পারে, আবার কেউ পারে না। প্রিয়াংসুটা সেই না পারারই দলে। তার জীবনে কোনদিন লক্ষ্য করিনি যে, সে কোন কাজ পারে না কিংবা তার দ্বারা কেউ উপকার পায়নি বা কেউ প্রত্যাশিত কোন জিনিস চেয়ে বিফল হয়েছে। কিন্তু সে ছিলো গো-বেচারা গোছের। কোনদিন কারোর প্রতি কোন অনুযোগ বা অভিযোগ করতে দেখিনি। কারোর জেনে-শুনে কোন ক্ষতি করেছে তা কখনও শুনিনি। কিন্তু এই ব্যক্তিটিকে কেমনে ভুলে থাকতে পেরেছি তা আজও আমি জানি না, আমার কাছে তা রহস্যই  থেকে গেছে। হয়। জানতাম যে, সে তেমন স্বপ্রতিভও নয় কিংবা আহামরি এমন কোন ব্যক্তিত্বও নয় যে, সে কারোর মনে গেঁথে যাওয়ার মতো কোন ম্যাজিক  চরিত্রের অধিকারী । সে কারোর মনে তেমন একটা দাগ কাঁটতে পারেনি। কিন্তু তার পারা উচিত ছিলো। তার মধ্যে আমি সেই রকম অঘোষিত নিরব প্রতিভা লক্ষ্য করেছি। যা তাকে তার বন্ধু-বান্ধবদের কাছে অতি আপনজন বা একজন অকৃত্রিম এবং নিঃস্বার্থ বন্ধু হিসাবে নিজেকে দাঁড় করাতে পারতো। সে ছিলো আমাদের বন্ধুমহলে সত্যিকার অর্থে নিরীহ বন্ধুবৎসল, নিরহংকার-সত্যবাদী ও জ্ঞানান্বেষী। কিন্তু আমরা তাকে সেইভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি বা তাকে সেই মর্যাদাটাও দিতে পারিনি। তাকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করা থেকে শুরূ করে অনেক বেআইনি কাজও আদায় করেছি! তাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছি। সেটা মনে হলে আজোও আমার মনে কেমন যেন অপরাধবোধ চলে আসে, মনটা না বোধক হয়ে উঠে! বিবেকটা এখনও কাঁদে। হেন কাজ নেই যে তাকে দিয়ে না করিয়েছি! মানুষ হিসাবে তার যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছি তা সত্যিকার অর্থে নিঃখুঁত ও নিবেদিত এক প্রাণ! আমরা প্রত্যেকেই এই নিরীহ সরল-প্রাণ, সত্যবাদী এক নিবেদিত মানুষের কাছে কম বেশি ঋণী। আর তাই তাকে আমরা কেউ মনে রাখিনি। কারণ, স্বার্থের কাছে আমরা সবাই বন্দী ছিলাম। স্বার্থ আমাদের প্রত্যেক জনকে অন্ধ করে দিয়েছিল। সে আসলেও আমাদের স্বার্থের বলি। তার কোন দোষ নেই, দোষ আমাদের। আমাদেরই তাকে মনে রাখার কথা। কিন্তু রাখিনি। সে অপরাধ আমাদের প্রত্যেকের। তার নয়।


 



বন্ধুটি একটু অভিমানীও বটে। কারো দয়া-দাক্ষিণ্য, করুণা বা প্রত্যোপকার কোনদিন নেয়নি। অন্যকে দিয়েছে বিনে নিজে কোন কিছু নেয়নি। কিন্তু এই সরল-নিরীহ সর্বকাজে কাজীটা এমন কঠিন সিদ্ধান্ত কিভাবে নিতে পেরেছে তা আমার কাছে এখনও রহস্যই রয়ে গেছে। আর কেমনে সে আমাদের মাঝখান থেকে হারিয়ে গিয়েছে কোনদিন জানিওনি। বিশেষ করে আমার পক্ষে তা জানার সুযোগ হয়নি। সাংসারিক ব্যস্ততা আর দুরে চাকুরী নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলাম। মাঝখানে বন্ধুদের কাছে জেনেছি যে, তাকে নিয়ে গ্রামে কি যেন একটা ঘটনা রটেছিল; যার কারণে তাকে গ্রাম থেকে নিরুদ্দেশ হতে হয়েছিল। এই চিন্তাটাই সেই মুহূর্তে আমাকে দূর অতীতের দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে বর্তমানে এনে আছাড় দিলো। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে নত মস্তকে প্রিযাংসুর সামনে একজন দাগী অপরাধীর মতো ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেম। যতক্ষণ পর্যন্ত ছিলাম তার সামনে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই অপরাধবোধ আমাকে ক্ষণে-ক্ষণে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। আমি বর্তমানকে ভুলে গিয়ে কতক্ষণ যে এক পায় দাঁড়িয়ে ছিলাম কে জানে! আমরা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ অটোরিক্সার হর্ণ শুনে আমাদের স্তম্ভিত হয়ে ফিরে আসে। সে বলে উঠলে-

-              তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে রইলে কেন রবিন! আমার লজ্জা হচ্ছে। চল স্টলে গিয়ে বসি-আলাপ করে কিছুক্ষণ।

আমি স্তম্ভিত ফিরে পেয়ে আর গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম-

-              হ্যাঁ- চল। চা খেতে-খেতে আলাপ করা যাবে

আমরা দুজনে উপজেলা স্বাস্থ্য কপ্লেক্সে মোড়ের একটা স্টলে গিয়ে বসলাম। ওয়েটারকে ডেকে দুজনের জন্য সামান্য কেক আর চা  অর্ডার দিয়ে আমরা পরস্পর মুখোমুখী বসলাম। সামনে আমাদের খোলা দরজা, পশ্চিম দিক থেকে মধ্য বর্ষার কড়া রোদের ঝিলিক। সামনের জমিতে এক কৃষক তার জমি আধুনিক হাল কর্ষণের যন্ত্র ট্রাকটার দিয়ে এই প্রখর রোদেও কর্ষণ করে যাচ্ছে। আর প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যেন তার ধানী জমিতে কোন আগাছা না থাকে। সব আগাছা নিজ হাতে কুড়িয়ে কুড়িয়ে এনে আইলের উপর ফেলে দিয়ে আবার ভালো করে তা খুঁটিয়ে দেখে চালককে সেদিকে নির্দেশনা দিচ্ছে। আবার সেদিকে মন দিচ্ছে। কারণ, এই একমাত্র ধানী জমি, যে জমির উপর তার গোটা সংসার, পরিবার-পরিজন নির্ভরশীল। যেখান থেকে তার আয়-রোজগার হবে, সেটা দিয়েই তাকে পুরো বছর চলতে হবে। এটাই যে তার সারা বছরের অর্জন। যদি ভালো ফসল উৎপাদন না হয় তবে তাকে ও তার পরিবারকে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করতে হবে। এই কৃষি ছাড়া কোন উপায় তার সামনে খোলা নেই। আমি সেদিকেই বেশী মনোযোগ দিলাম। কারণ, এই মুহূর্তে আমরা দুই বন্ধু যে বাস্তবতার মাঝে বসে আছি এবং যে বিষয়টি আমরা কিছুক্ষণ পরে অবতারণা করবো; তার মূল কারণ তো সেটাই। আর এ কারণেই আমাদের বন্ধুত্বেরও দীর্ঘ দিনের ছেদ্। যা আমাদের উভয়কেই আড়াল করে রেখেছে। অবশ্য প্রতিটি মানুষের আশা-আকাঙ্খা থাকে একটি সুখের সংসার, শান্তিময় এক পরিবার। যেখানে মানুষ সব ব্যথা-বেদনার সান্ত্বনা খোঁজে, আশ্রয় খোঁজে। হাজার কষ্ট-দুঃখের মাঝেও মানুষ যেখানে শান্তি বা স্বর্গ অনুভব করে এবং শান্তির একমাত্র স্থান তো তার সংসার, পরিবার, তার সন্তান-সন্ততি। তো আমার এমন বিমর্ষ মন নিয়ে বসে থাকার কারণে বন্ধুটিও আনমনা হয়ে আমার  দিকে এক ধ্যানে চেয়ে আছে আমি তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কোন কথা বলতে পারছিলাম না। কারণ দীর্ঘ ৩৬টি বছর তার সাথে আমার উঠা-বসা। সেই শিশুকাল থেকে কৈশোর আর পুরো যৌবনকাল। এই সেই বন্ধু যাকে বিশ্বাস করা যায়, আস্থা রাখা যায়, নির্ভর করা যায়। কিন্তু আজ তাকে দেখে কেন জানি মনটা বিস্বাদ উঠল। আর বিষাদে মনটা মুচড় দিয়ে উঠল। যাকে ২৪টি বছর দেখিনি, যাকে ছাড়া একমুহূর্থ থাকতে পারতাম না। সেই আমার সন্মুখে! যে আমাদের মাঝখান থেকে হারিয়ে গিয়েছিল! অথচ তাকে আলিঙ্গন করার কথা । কিন্তু মনটা এত নিরব হলো কেন বুঝতে পারিনি। সামনাসামনি বসেও কারও মুখে কোন রা নেই! আমরা দুজনেই নির্বাক বসে! আমাদের মুখ থেকে কথাগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল কেন জানে! কতক্ষণের জন্য আমরা নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। অবশেষে দোকানদারের কথায় আমার ধ্যান ভাঙলো। যখন সে জানান দিলো যে, আমাদের সামনে রাখা চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তখন আমাদের সামনে টেবিলে রাখা সদ্য গরম চা ঠান্ডা হয়ে একেবারে সরবত হবার যোগাড়! অগত্যা আবার দোকানদারকে আর এক কাপ গরম চায়ের ফরমায়েশ  দিয়ে আমরা আমাদের কথোপোকথন শুরু করলাম:-

-              এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? আমি প্রিয়াংসুকে প্রশ্ন করলাম।


-              তার আগে বলো তুমি কেমন আছ? আমাকে পাল্টা সে প্রশ্ন করে। আমি বললাম-


-              আছি ভাল। যেভাবে থাকার কথা - এই আর কি! আমার গুরুত্বহীন উত্তর শোনে সে আশ্চর্য হলো এবং পাল্টা প্রশ্ন করলো-


-              তার মানে-- তেমন একটা ভালো নেই? কিন্তু কেন?


-              এই যেমন- সংসার, চাকরী-বাকরী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে একটু সমস্যায়---সে আমার কথা শেষ করতে দিলো না। আমার কথা কেড়ে নিয়ে বললো-


-              কেন? সংসার করেছ, ছেলে-মেয়ে হয়েছে, তোমার তো ভাল থাকার কথা। শুনেছি ভাল মাইনের চাকরীও করছো। আমার মতো তো আর নও।


-              না। তোমার মতো নই। হলে বাঁচতাম!

-              কেন? তোমার স্ত্রী মিনুকে নিয়ে তুমি কি সন্তুষ্ট নও? সে তো ভাল ঘরের মেয়ে শুনেছি। বংশ মর্যাদা, প্রতিপত্তি, শিক্ষায়-দীক্ষায় অনেক উঁচুতে। সমস্যাতো হওয়ার কথা নয় রবিন। রবিন শোন- সংসারে সুখ-শান্তি যাই বলো সব কিছুই নিজের কাছে। জীবনে যা হয়েছে তা নিয়ে কোনদিন ভেবো না। পিছনে তাকাতে নেই। বিপদ বাড়ে, কষ্ট বাড়ে বৈ কিছু দেয় না বুঝেছ?

আমি অবুঝের মতো মুহূর্তে তার দু’হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললাম:-


-              রবিন তুমি আমাকে বাঁচালে! না না সে খুব ভাল মেয়ে। তার কোন দোষ নেই। আমি জানতাম তোমার মতো বন্ধু আমি জীবনে কখনও পাইনি, দেখিনি আর পাবও না। তোমার মতো বন্ধু আর কার আছে বলো? তোমার এই পরামর্শ আমার জীবনে মনে থাকবে। কিন্তু এখন তোমার কথা বলো- তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? কেমন ছিলে আর এখন কোথায় আছ? কি করছ? তোমার বর্তমানের কথা বলো প্রিয়াংসুÑÑÑ


-              কিন্তু আমি তো তোমার কথা শোনার জন্য আজ বসেছি রবিন। তোমার কথায়ই শুনতে চাই। আমার কথা নাই বা শুনলে।


-              কিন্তু এতদিন পরে তোমাকে এইখানে পেলাম। আমার সৌভাগ্য যে তোমাকে পেয়েছি এমন এক সময়ে যা আমাদের জন্য সত্যিকার অর্থেই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এতক্ষণ আমি আমার কথা বললাম এখন তুমি তোমার কথা বলো প্রিয়াংসু। আমি তোমার কথা জেনেছি যে, তুমি কোথাও যেন হারিয়ে গিয়েছিলে। কেউ তোমার কথা জানাতে পারেনি। শুনেছি তুমি দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলে কিন্তু কেন? তোমার তো ইয়ে ছিল তারই বা খবর কি?

প্রিয়াংসু দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে বললে-

-              কিন্তু রবিন সে তো অতীতের কথা। বর্তমানের কথা বলো রবিন।

-              না আমি সমস্ত কিছুই তোমার মুখে শুনতে চাই প্রিয়াংসু। কারণ, তোমার নামে বন্ধুমহলে বহু মূখরোচক কহিনী শুনেছি যা আমি বিশ্বাস করতে পারিনি।

-              তাহলে শোন রবিন- বলে সে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এক এক করে বলতে শুরূ করল-

-              তোমরা জানতে আমি কোনদিন কারো উপকার বিনে অপকার করিনি। জেনে-শোনে কারো ক্ষতি করিনি। তোমাদের কাছে আমি যেমন একজন ভাল মানুষ হিসাবে পরিচিত ছিলাম, বাইরের মানুষের কাছেও তাই ছিলাম তা তুমি জানো। কিন্তু এই ভালত্ব আমার কপালে একদিন এমন মন্দত্ব নিয়ে আসবে আমি ভাবিনি। তুমি তখন বোধহয় সদ্য বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ী চলে গেছ। আর আমি আমার স্বভাব মতো বাবার হোটেলে খাই আর টোটো কোম্পানির ম্যানেজারগিরি করি আর সাহিত্য চর্চা করি। প্রতিদিন বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিই। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। কোথাও অনুষ্ঠান হলে সেখানে উপস্থিত হই। নিজের উপস্থিতি মানুষের কাছে জানান দিই। সাহিত্যের কোন আসর হলেতো কোন কথায়ই নেই। এই নিয়েই আমার ব্যস্ততার দিন কেঁটে যাচ্ছিল বেশ। কিন্তু একদিন এই সাহিত্য আসরে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে লাগল এক বিপত্তি। আমরা অনুষ্ঠান শেষ করে কয়েক বন্ধু মিলে আর এক বন্ধু জিমির বাড়ীতে বেশ আড্ডা জমাচ্ছিলাম। আড্ডা বেশ জমে উঠছিল। আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভষ্যিতের লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা করছিলাম। ভবিষ্যৎ কর্ম-পন্থা কি হবে, কিভাবে গারো সমাজের বর্তমান অচলায়তনকে এইসব অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করা যায়- সেইসব উন্নয়নের কথা আলোচনা করছিলাম। সাহিত্যের কাছাকছি আলোচনা চলছিল। তো রাত প্রায় তখন ২:০০ টা বাঁজে। আমরা আমাদের সেই আসর শেষ করে নিজ নিজ বাড়ীর উদ্দেশ্যে বের হয়েছি। কিন্তু শেখরটা কখন যে আমাদের আগেই আসর থেকে বের হয়ে রাস্তায় গিয়েছে আমরা কেউ তা টের পায়নি। তুমি নিজেও জানতে যে, তার বোনের সাথে আমার বিয়ের কথা-বার্তা চলছিল। কিন্তু আমি আসলেও অন্য চিন্তা করছিলাম। অর্থাৎ আমি চাইনি বিয়ে বা সংসারে তখনই জড়িয়ে পড়ি। তাছাড়া সবিতার প্রতি আমার না ছিল কোন দুর্বলতা, না ছিল কোন আকর্ষণ। শ্রেফ বন্ধুত্ব। গ্রামের প্রতিবেশী হিসাবে বা মামাতো বোন হিসাবে যে রকম সম্পর্ক থাকার কথা ঠিক তাই-ই ছিল তার সাথে। এর বেশী কিছু নয়। কিন্তু মানুষ সেইসব নিয়ে মুখরোচক কাহিনী বানিয়ে আমার বিরূদ্ধে প্রচারণা শুরু করে। তার মধ্যে শেখর নিজেও জড়িত। কিন্তু আমি কখনও তা পাত্তা দিইনি। একদিন এই বিষয় নিয়ে শেখরের সাথে আমার তুমুল তর্ক বাঁধে। এক আসরে বসে যখন আমরা ‘বর্তমান সমাজ ও গারো নারী’ বিষয়ক গম্ভীর তাৎপর্য্যময় আলোচনা করছিলাম; তখন কথা প্রসঙ্গে তার সেই বোনের কথাও চলে আসে। পুরূষদের ভুমিকার সাথে সাথে নারীর  কি ভুমিকা হওয়া উচিত- এই প্রসঙ্গে যখন চলে আসি তখনই শেখর আমাকে বাঁধা দেয়। যা কারো কাম্য ছিল না। কিন্তু শেখর ছিল নাছোরবান্দা। ঐদিনও এই প্রসঙ্গটা আলাপ-আলোচনায় চলে আসে এবং শেখর ভিষন ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সে কিছুতেই আমার বর্তমান ভুমিকাকে মেনে নিতে পারছিল না। এবং সে তার বোনের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমাকেই দায়ী করে। কারণ, সবিতাকে নিয়ে তাদের যে চিন্তা-ভাবনা, ইচ্ছা তা কোনদিন বাস্তবে ঘটবে না জেনেই আমার প্রতি সম্পূর্ণ পরিবারটি দায় চাপিয়ে দিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। আমাকে বলির পাঁথা বানিয়েছিল। সেদিন শেখর তার অন্য বন্ধুদের নিয়ে আমার পথ আগলে দাড়িয়েছিল সেই গভীর রাতে। এবং জোর করে আমাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল। আমাকে প্রচন্ড মারডোর করে রক্তাক্ত মৃতপ্রায় অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রেখে গিয়েছিল। এই পযর্ন্ত এসে প্রিয়াংসু সামনে রাখা চায়ের কাপে একটা চুমুক দেয়ার প্রয়াস পেল। আমি লক্ষ্য করলাম যে তার দু’চোখ লাল হয়ে গেছে এবং চোখ দু’টো টলটলায়মান। জানি সে অনেক কষ্টে তার বুকের অব্যক্ত ব্যথা চাপা দেয়ার জন্য ব্যর্থ প্রয়াস নিচ্ছে। আমি তার সেই জলে আচ্ছন্ন চোখের দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম-

-              তারপর

-              তারপর তো হাসপাতালে দীর্ঘ ১ মাস কাটালাম। আমার শুভাকাঙ্খী বন্ধুরা এসে আমাকে রক্ষা করে এবং উপজেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়। তারাই সমস্ত কিছুর খরচ বহন করেছে।

-              কিন্তু সেই শেখরটা?

-              সে তো দিব্যি বহাল তবিয়তে থেকে আমার বিরুদ্ধে টাকা চুরি আর নারী ধর্ষনের মতো মিথ্যা মামলা ঠুকে দেয়। একজন প্রতারক-মিথ্যাবাদী নিজ স্বার্থের জন্য কি না করতে পারে, বাস্তব উদাহরণ এই শেখর।

-              তারপর!

-              তারপর মামলা-মোকদ্দমা দিয়েই সে ক্ষান্ত হয়নি। সে আমাকে থানার পুলিশ নিয়ে গিয়ে হাসাপাতাল থেকেই তুলে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু মিথ্যার একটা শেষ পর্যায় আছে, সত্যেরও জয় আছে। আমি দীর্ঘ প্রায় ১টি বছর সেই মামলার আসামী হয়ে কোর্ট-কাছারী করেছি। আমার স্বপ্ন-সাধ সব কিছুই বিসর্জন দিতে হয়েছে শুধু একটা মিথ্যা প্রেমের জন্য। আমার মা পাগল প্রায় হয়েছে। আজোও নাকি মা আমার পথপাণে চেয়ে কাঁদে আর চোখের জল ফেলে। আমার বোনচারীদের উপর মামলার পর মামলা করে হেনস্থা করেছে। মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে আমার মা-বাবা, ভাই-বোন সর্বসান্ত হয়েছে। তাদের লক্ষ্য ছিল যেনতেনভাবে আমাদের পরিবারকে গ্রাম ছাড়া করতে। তাদের এই দূরভিসন্ধি আমরা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাই আমিও  ঘর ছাড়লাম। ছাড়লাম এই কারণে যে, এই পোড়া মুখ আর কাউকে দেখাব না। ভাবতে পারো যে, কেন আত্ম হত্যা করিনি। না, সেই কাপুরুষের কাজ আমি পছন্দ করি না।


-              কেন? এখন তো শেখরদের পারিবারিক অবস্থাও শোচনীয়। তুমি তো এখন তার বদলা নিতে পারো। পারো নাকি?

-              না। পারি না। প্রতিশোধ নেয়া আমার কাজ নয়। সেটা একমাত্র কাজের ফল হিসাবেই এসেছে বলে ধরে নাও রবিন। কোনদিন প্রতিশোধপরায়ণতা নিয়ে কোন শত্রুকে হেয় করো না। বরং পারলে ক্ষমা করতে চেষ্টা করো। দেখবে তোমার মনের মধ্যে একটা অনাস্বাদিত সুখ আর শান্তি বয়ে যাচ্ছে। আমি আমার দীর্ঘ দুই যুগের লম্বা যাত্রায় সেই অভিজ্ঞতাই অর্জন করেছি। রবিন তুমি বিশ্বাস করবে না আমি ইচ্ছে করলেই কারি কারি সুখ কিনতে পারতাম এবং এখনও পারি। কিন্তু এই সুখই সর্বশেষ নয় রবিন। সুখ বা শান্তি যাই বলো তা সাময়িক এবং তা তোমার অন্তরে। আমি সেই সুখকে এখন ধারণ করি। এবং আমার সেই সুখকে সবার সাথে ভাগাভাগি করতেই বাড়ীর উদ্দেশ্যে পা দিয়েছি। আমি জানি আমার অপেক্ষায় কেউ নেই। আর জানি বলেই আজ দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ পরে বাড়ীতে আসছি। আমার তো আর কোন পিছু টান নেই। হ্যাঁ, আমি বাড়ি যাচ্ছি রবিন!! এই বলে সে স্টল থেকে উঠে পড়লো। আমি তাকে দ্বিতীয়বার যে চায়ের অফার দেবো, সেই সুযোগ আমাকে দিলে না। আমি নিজের অজান্তেই অসহায়ের মতো তার ডান হাতের দিকে নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। সে দ্রত গতিতে যেতে যেতে বললো, দেখা হবে আবার। রবিন ভাল থেকো বলে চায়ের বিল পরিশোধ করে উত্তরমূখী সামনের রাস্তায় পা বাড়ালো। তার সেই গমন পথের দিকে চেয়ে চেয়ে এই উপলব্ধিই হলো যে, যদি এমনই মনের অধিকারী সকলে হতো- তাহলে এই জগতটা কতই না সুন্দর হতো !

Post a Comment

Previous Post Next Post