আমার মা

সিস্টার  মেরী প্রশান্ত, এস এম আর এ :  তখন বর্ষাকালের শুরু মাত্র। খালে নূতন পানি এসেছে। নূতন পানিতে ডুবাডুবি করার মত আনন্দের বিষয় আর কিছু  আছে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের জন্য।

একদিন স্কুল থেকে এসে পাগলের মত কোন ভাবে বই-খাতা বারান্দায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে দৌঁড়ে নেমে পড়েছিলাম খালে। বর্ষাকালে খালের রূপটা এমন হয় যে, নদীর চেয়েও ভয়ানক হয়ে উঠে। প্রবল স্রোত কচুরী-পান্না, আশে পাশের সমস্ত আবর্জনা ধলিতে নিয়ে  ফেলে। এমনতর স্রোতের মধ্যে সাঁতার কাটার মত মজাদার আর কি হতে  পারে? একবার নামতে পারলেই হল, উঠবার আর নাম নেই। মা রান্নার কাজে ব্যস্ত, দাদারা বিশেষ কাজে কোথাও গিয়েছে। তাই সেদিন লগ্গি দিয়ে  বাইরিয়ে আমাকে জল থেকে উঠানোর মত বাড়ীতে আর কেউ ছিল না। ভাবলাম, আজকেই সুযোগ, যতক্ষণ পারি ডুবিয়ে  নেই। সেই যে নেমেছিলাম ১:৩০ টার সময়, তিনটা বেজে গিয়েছে। এর মধ্যে মা ও কাকিমা কয়েকবার এসে উয়ার্নিং দিয়ে  গেছেন। কাকিমা বলেছেন, "দেখ মা, জ্বর এলে কিন্তু খালে নিয়ে ডুবিয়ে রাখব"। কারো কথায়ই আমার ভ্রুক্ষেপ নেই। ডুবচ্ছি তো ডুবাচ্ছি, সাঁতরাচ্ছি তো সাঁতরাচ্ছি। চোখ দু'টি আমার কোকিলের মত লাল হয়ে গেছে। 



এক পর্যায়ে দাদা এসে হাজির। ইতি মধ্যে মা, কাকিমা, মেঝ মা সবাই দাদার কাছে নালিশ করে ফেলেছে। এবার আমার বিচারের পালা। প্রথমে এক দাদা জলে নেমে আমার মাথার চুলের মুঠি ধরে পানি থেকে খালের পারে উঠিয়ে  ঘারে ধরে বাড়ীতে নিয়ে  গেল। শুধু বলে দিল, এখন ভিজা কাপড় ছেড়ে ঘরে গিয়ে  বসে থাক্, সন্ধ্য বেলা বিচার হবে, বুঝলি? 

তারপর খেয়ে দেয়ে বিছানায় গিয়ে শুতে না শুতেই কাঁপিয়ে  কাঁপিয়ে জ্বর আসতে শুরু করল। কি আর করা, কারো কাছে বলার তো মুখ নেই। চুপচাপ  শুয়ে আছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে  এল। একা একা কাঁদতে শুরু করলাম।

যখন বিচারের জন্য ডাক পড়ল, তখন আমি জ্বরে প্রচন্ড ভাবে কাঁপছি,  বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। মা আমার গায়ে হাত দিয়ে  দেখল,  আমার গা পুড়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় আর বিচার হবে কি করে?। আমি মনে মনে ভাবছিলাম কাকিমার কথা মত আমাকে কি খালে নিয়ে ডুবিয়েই রাখে নাকি,;কেউ আমাকে কিছুই বলল না, বরং দাদকে পাঠাল ডাক্তার আনতে। মা আমার কাছে বসে বসে মাথায় জল পট্টি দিতে লাগল, কাকিমাও মাথা টিপে দিতে লাগল। ডাক্তার এসে ঔষধ দিয়ে চলে গেল। 

আমার ছোট বোনটা তখন খুবই ছোট্ট। রাত যতই বাড়ছে আমার জ্বরও ততই বাড়ছে, মা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল। বোনের জন্য মাকে প্রায় সারা রাতই জেগে কাটাতে হত। মা বোনের যত্ন করবে, নাকি আমার যত্ন করবে? ঔষধ খাওয়ার পর এক পর্যায়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।  মাও তখন চোখ দু'টো বন্ধ করেছে মাত্র। রাত দু'টোর দিকে আমি দুঃস্বপ্ন দেখে হঠাৎ মা মা বলে চিৎকার করে উঠলাম। মার ঘুম ভেঙ্গে গেল  আমার চিৎকারে। মা উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন,  কি হয়েছে? মাকে ধরে আমি আরো চিৎকার করতে লাগলাম। একটু সুস্থির হয়ে বললাম, আমি স্বপ্নে দেখেছি, কে যেন আমার মাথাটা জোর করে পানির তলায় ডুবিয়ে  দিচ্ছে। আমি দম ছাড়তে পারছিলাম না। তখন বাড়ীর সবাই  অঘোরে ঘুমাচ্ছিল, শুধু মা-ই আমার মাথার কাছে বসে জেগে ছিল।

মা শুধু বলল, " না তোকে কেউ পানির নীচে  ডুবাতে পারবে না। আমি তো আছি, কোন ভয় নেই, তুই ঘুমিয়ে  থাক্"।

সত্যিই তো মা কাছে থাকলে কি সন্তানের কোন বিপদ হতে পারে?


[জীবন ও সমাজে- পাঠাতে পারেন আপনারও বস্তুনিষ্ঠ লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ] 

[দৃষ্টি আকর্ষণ: যদি মনে করেন এমন কোন আলোকিত ব্যক্তিকে নিয়ে আমাদের জীবন ও সমাজের অনলাইন ম্যাগাজিনে বিশেষ ফিচার করা যেতে পারে, তাহলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আমরা সেই ফিচার করে তার আলো ছড়াবো, যাতে অন্যরাও সেই ব্যক্তিত্বের আলোয় আলোকিত হতে পারে। 

 আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন : jibonoshomaj@gmail.com] 

[পাঠকদের  দৃষ্টি আকর্ষণ:  করোনাকালে আপনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের এমন কোন অগ্রণী ভূমিকা কি ছিল যা নিয়ে জীবন ও সমাজ-এ ফিচার করা যেতে পারে। তাহলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন : jibonoshomaj@gmail.com]  


Post a Comment

Previous Post Next Post