বকশিশ

ব্রাদার নির্মল ফ্রান্সিস গমেজ সিএসসি :  সেদিন সবেমাত্র খেয়ে বের হলাম। আমার এক ক্লাসমেট সংবাদ দিল; তোমার চিঠি এসেছে। অধীর আগ্রহ নিয়ে গেলাম। পিয়ন সাহেব আমাকে দেখেই বুঝতে পারলো চিঠিটা নিশ্চয়ই এই ভদ্রলোকের। চিঠিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “দেন, পাঁচটা টাকা দেন।” আমি প্রশ্ন করলাম, “কেন? পাঁচ টাকা কেন?” “এতো কষ্ট করে আপনার বাসায় আসলাম একটা টাকা বেশি দিবেন না? এক টাকা বকশিশ দেন।” হাসিমুখেই বললো সে। আমি নিশব্দে চারটা টাকা বের করে দিলাম। কারণ বেয়ারিং চিঠি চার টাকাই আমার জানা ছিলো। লোকটা বললো, “কি ভাই, আর এক টাকা দিবেন না?” “আজকের মতন এখানেই থাক।” জবাব দিলাম আমি। সে জবাব দিলো, “এতো কষ্ট করে মাত্র এক টাকা চাইলাম তাও এমন করছেন?” আমাদের পাশেই কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিলো। সবার সামনে আমি বললাম, “অবশ্য একটু আয় বনি করেই। আমি এক টাকা বেশি দিলে এরা সবাই হাসবে আর আমাকে লজ্জা দিবে, কারণ আমি আপনাকে হিসাবের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে দিবো তাই। সবাই আমাকে বোকা বলবে। লোকটা কোন জবাব না দিয়ে মুখ ভার করে চলে গেলো। জোর করে কি আর বকশিশ আদায় করা যায়?

বকশিশ

বকশিশ বা বখশিশ কথাটার অভিধানিক অর্থ পুরস্কার। পুরস্কার কথাটি ইতিবাচক একটি বাংলা শব্দ। কোন ছাত্র স্কুলে ভালো রেজাল্ট করলে বা কোন অফিসে কোন কর্মচারী ভালো সার্ভিস দিলে বা সন্তান কোন ভালো কাজ করলে পিতা-মাতা খুশী হন এবং তাদের ন্যায্য পাওনার অতিরিক্ত কিছু দেওয়া হয় তা হলো বকশিশ। এই বকশিশ শব্দটি অনেক আগে থেকেই বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু ইদানিং দেখা যাচ্ছে এর ব্যবহার একটু তোর-জোরভাবে চলছে। তোর-জোরভাবে ব্যবহার হওয়ার কারণ হলো দু’দল মানুষ এর অর্থকে দুইভাবে দেখছে। যারা এই অভিধানিক অর্থ মানে ও ব্যবহার করে তাদের কাছে এটা ইতিবাচক শব্দ। কিন্তু অন্যদল আছে, যারা নেতিবাচক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বাক্যটাকে ইতিবাচক হিসেবেই ব্যবহার করে থাকে। আসলে তাদের উদ্দেশ্য নেতিবাচক। যেমন ধরুন- আমাদের স্কুলে বছর শেষে ছাত্রদের পুরস্কার বা বকশিশ দেওয়া হয়। তবে সবাইকে নয়; যারা সারা বছর পূর্ণভাবে ক্লাসে উপস্থিত ছিলো, যারা ১-৫ পর্যন্ত স্থান পেয়েছে, খেলাধুলা, স্কাউট ও অন্যান্য দিকে ভালো ছাত্রদেরও পুরস্কার ও বকশিশ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে বকশিশ কথাটির ব্যবহার অভিধানিক ও ইতিবাচকরূপেই। অপরদিকে, দেখেছি অনাত্মীয় অথচ পরীক্ষার হলে নকল সরবরাহ করেছে বলে পরীক্ষার পর বের হয়ে তাকে হাতে গুঁজে বকশিশ দেওয়া হচ্ছিল। কারণ কি? কারণ পরদিন পরীক্ষা দিতে গিয়েতো আবার তার শরণাপন্ন হতে হবে। এমনিভাবে হোক অফিসে, রাস্তা-ঘাটে, যানবাহনে বা হোক তা হাঁটে-মাঠে বলতে গেলে জীবন পথে সব জায়গায় এমন বকশিশ দেওয়া-নেওয়ার ঘটনা আমাদের কাছে ইদানিং অবাস্তব বা আশ্চর্যজনক কিছুই না। এ যেন মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কাজ কে বা কারা করে তা নির্ধারণ করা সত্যিই সুকঠিন কাজ। কারণ জ্ঞানী-গুণী, ভদ্র ও শিক্ষিতমহল সহ প্রত্যন্ত গ্রামেও এর প্রচলন অতি ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের সমাজ জীবনের জন্য এটা যেমন হতাশাজনক, তেমনি লজ্জাজনক। এই বকশিশ প্রথা প্রকৃতই বকশিশ নয় বরং এটা ‘ঘুষের’ নামান্তর মাত্র। অর্থাৎ স্বার্থ উদ্ধারকারীরা ঘুষের একটা ভদ্র নাম দিয়েছে তা হল ‘বকশিশ’। এই নাম দেওয়ার পিছনে যুক্তিযুক্ত কারণ আছে বলেই আমার ধারণা। কারণগুলি হতে পারে- - দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের মানহানী ঘটার ভয়। - মুখে প্রকাশ করা সহজ। - তাদের মধ্যকার প্রকৃত মনুষ্যত্ববোধ তাদের বাঁধা দেয় ঘুষ নামে কিছু গ্রহণ করতে। এমনি আরও অনেক কিছু। আমার ধারণামতে, বর্তমান বাংলা অভিধান পুনসংস্করণ করার সময় দুই দলের মধ্যে চরম একটা মতবিরোধের দেখা দিবে। যারা ন্যায়বান মানুষ ও প্রকৃতই জ্ঞানীগুণী তারা বকশিশ কথাটির দুটি অর্থ লিখতে চাইবেন প্রথমটা (ইতিবাচক) পুরস্কার, দ্বিতীয়টা (নেতিবাচক) ঘুষ। কিন্তু স্বার্থবাদীমহল এর তীব্র প্রতিবাদ জানাবে। কারণ তাদের আত্মসম্মানের ওপর, মানের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়ে যায়। তাই তারা এর অর্থ শুধুই পুরস্কার লিখতে চাইবে। হয়তো বিরোধী দল অর্থাৎ স্বার্থবাদী দল জিতে যাবে কারণ তাদের সংখ্যা হবে বেশি। আর তখন হয়তো বকশিশ কথাটার মূল অর্থ হারিয়ে যাবে। 

কিন্তু মজার বিষয় হলো অভিধানে তো এমন কোন শব্দ নাই যে বকশিশ কাজ বা বকশিশ ঘুষ। যারা তখন সেই ধরনের বকশিশ নিবে, তাদের কি আর ঘুষখোর বা ঘুষ কাজ বলে ডাকা যাবে। মনে হয় না তখন তাদের আর কোন নামে চিহ্নিত করা যাবে। যেহেতু, বকশিশ কথা দ্বারা ঘুষের ব্যবহার মিটে যাবে, তখন ঘুষ বা ঘুষ কাজ বা ঘুষখোর হয়তো অভিধানে কোন প্রয়োজন থাকবে না। যাই হোক, আসল কথা হলো এই আমরা সুস্পষ্টই লক্ষ্য করতে পারছি এর পিছনে কাজ করছে আমাদের সামাজিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। আমরা প্রত্যেকে প্রতি পদে, প্রতিঙ্গনে যদি সজাগ না থাকি; তবে বর্তমানের এই বকশিশ প্রথা আমাদের সমাজের নীতিবোধ ও মূল্যবোধকে রসাতলে নিয়ে যাবে এর বিকল্প নেই।

(আপনাদের মূল্যবান, বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যবহুল লেখনী, গল্প, প্রবন্ধ ও  ধারাবাহিক কলাম আহ্বান করি। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: jibonoshomaj@gmail.com)

Post a Comment

Previous Post Next Post