কালো বইটি


ব্রাদার নির্মল ফ্রান্সিস গমেজ, সিএসসি : নিত্যদিনের মত আজও সুমন ফিরে এলো সন্ধ্যায় ঘোরা-ফেরা করে। কোথায় যায় সুমন? প্রায়ই মা প্রশ্ন করেন। কিন্তু কোন উত্তর পান না সুমনের কাছ থেকে। খোঁজ করে দেখার চেষ্টা করেন, কিন্তু তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আসলে, শহরের ব্যাপারতো তাই বাসা থেকে বের হলে কাউকে খুঁজে যাওয়া বড় দায়। সুমন আজ ঘুমাচ্ছে না। পায়চারী করছে তার রুমের ভিতরে। মধ্যরাতে মা সুমনের পায়চারী লক্ষ্য করে ভাবলেন হয়তো কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পরবে, বাইরে আজ আর যাবে না। বেশি চিন্তা না করে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। ছোট ভাই লিটন অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে মায়ের রুমে। বাবাতো দুই বছর যাবৎ ঢাকার বাইরে। অর্থাৎ খুলনায় কাজ পেয়েছেন। কয়েক মাস পর-পর আসেন। সুমনের চিন্তা আর একটু পরই বাসা থেকে বের হতে হবে। আজ একটা ছোট্ট অপারেশন আছে অর্থাৎ সেদিন যে ভদ্রলোক নীতিবাক্য শুনিয়ে তাদের গালাগালি করেছে তাকে শায়েস্তা করতে হবে আজ। লোকটা নাইট ডিউটি করে। ঠিক ১২টায় বন্ধুরা অপেক্ষা করবে বদ রাস্তার সেই ছাউনির পাশে।

কালো বইটি

ইতোমধ্যে, মা ঘুমিয়ে পরেছেন। বড় ফটকের চাবিটা হাতে নিয়ে বইয়ের সেল্ফ থেকে টান মেরে বের করল দুদিকে ধারালো ছোরাটা। কিন্তু যে বইটার ফাঁকে রাখত সেই বইয়ে ঝাঁকুনি লেগে পড়ে গেলো ঘরের মেঝেতে। আর বেশ শব্দ হলো। বইটার উপর রাগ হলো তার কারণ মা হয়তো সজাগ হয়ে গেছেন। তবুও সে গেলো বইটা স্বযতনে তুলে রাখতে। কারণ এটাই একমাত্র কালো বই যার পিছনে রাখলে তার যন্ত্রটা অতি গোপনে থাকে। তুলতে গিয়ে তার মনে হলো বইটা একটু পড়ি, যদি মা সজাগ হয়েই থাকেন, তবে আবার ঘুমিয়ে যাবেন। পরে গিয়ে যে পৃষ্ঠাটা খুলে গিয়েছিলো সেখান থেকেই পড়তে শুরু করলো সুমন। হঠাৎ তার শরীর কাঁপতে শুরু করলো। বইটা বিছানার উপর রেখে দিয়ে নিজেকে একটু সামলে নিলো সে। তারপর আবার একই অংশ পড়লো যা পড়ে তার এই অদ্ভুত অনুভূতি জাগলো। সেই পৃষ্ঠায় একটা লাইনটিতে লেখা ছিলো, “তোমার খরগ্টা যেখানে থাকার কথা, আবার সেখানেই রেখে দাও। যারা র্খগ ধরবে, তারা সবাই র্খগের আঘাতেই মরবে।” (মথি ২৬:৫২ পদ)

তারপর তার মনে শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন। একথা কি শুধু আমার জন্য বলা হচ্ছে? আমি কি তবে খর্গধারী। তবে কি আমাকে র্খগের আঘাতেই মরতে হবে? এখন আমাকে কি এটা ফেরত দিতে হবে বন্ধুকে? নানা প্রশ্নের পর তার ইচ্ছা হলো বইটা ও তার মালিকের নাম জানার। বইটা বন্ধ করলো, দেখলো উপরে বড় করে লেখা আছে ‘মঙ্গলবার্তা’ আর প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা তার বাবার নাম। এবার মনে হলো, বাবা বাসায় থাকতে এই বইটা পড়তেন বেশি। এখন এখানে পড়ে আছে, কেউ ব্যবহার করছে না। বাবা যাওয়ার সময় তা সঙ্গে নিতে ভুলে গেছেন। আর এটাই তার গোপন স্থান। এরকম হাজারো চিন্তা করতে-করতে কখন যেন সুমন ঘুমিয়ে পড়লো। বাইরে যাওয়া আর হলো না। পরদিন ক্লাশে যাওয়ার সময় দেখা হলো বন্ধুদের সাথে। সবাই তাকে ভীতু বলে উপহাস করতে শুরু করলো, কিন্তু সুমন নম্রভাবে সব বললো আগের রাতের কথা। তারা সবাই হাসাহাসি করে চলে গেলো। কিন্তু সুমন থলি থেকে বের করে ছোরাটা সেই বন্ধুকে দিয়ে দিলো, যার কাছ থেকে সে এটা এনেছিল। 

সেদিন থেকে সুমন তার পড়ার বইয়ের চেয়ে বেশি যত্ন নিতে শুরু করলো সেই বইটার। সময় পেলেই পড়ে ও ধ্যান করে। দশম শ্রেণির ছাত্র সে, তাই তা বুঝতে কষ্ট হয় না তার। সেদিন থেকে সুমনের মধ্যে আর কুচিন্তা স্থান পায় না। সে তার জীবনের জন্য পেলো এক মঙ্গলবার্তা ও পরিবর্তন। তা হলো সেই অমূল্য কালো বইটির সুবাদে।


[জীবন ও সমাজে   পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com]


Post a Comment

Previous Post Next Post