সঠিক পরিকল্পনার অংশ হোক বিবাহ

 কাজল রোজারিও :

মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে সঙ্ঘবদ্ধ জীবন-যাপনই সহজাত প্রবৃত্তি। সে একা বসবাস করতে পারে না। তাই তার প্রয়োজন সঙ্গ লাভ। আদম ও হবা অথবা হাওয়ার কথা শুনে বা জেনে আসছি পূর্ব থেকেই। সৃষ্টিকর্তা প্রথমে সৃষ্টি করেছেন আদমকে। তার কাছে পূর্ণতা পায়নি, তাই তিনি আদমের সঙ্গী হিসেবে সৃষ্টি করেন হবাকে। সৃষ্টিকর্তার বিশেষ আশীর্বাদ ছিল তাদের ওপর। তারা একদিন ফলশালী হবে ও এই বিশ্বকে এবং বিশ্বের সকল কিছুর ওপর আধিপত্য করবে। আদম ও হবা ছিলেন পরস্পর উভয়লিঙ্গের প্রতীক। তারা পরস্পর দুটি আলাদা দেহ হলেও, এক দেহ হয়ে ওঠে। ফলে তাদের মধ্যে বিশেষ একটি বন্ধনের স্থাপন হয়। একটি অনুমোদিত দৃঢ় সংকল্পে আবদ্ধ হয় উভয়ই। যা হলো 'বিবাহ'। বিবাহ হলো নারী এবং পুরুষের জীবনের একটি মহৎ অংশ।

বিবাহ কেন করা হয় ? এখানে ভিন্ন জনের ভিন্ন-ভিন্ন মতামত পোষণ হতে পারে। নারী পুরুষের জৈবিক ক্রিয়া সাধনের জন্য। একে-অপরের জীবন সঙ্গী হয়ে সারাজীবন এক সাথে কাটানোর জন্য। জীবনটা একা পূর্ণতা পায় না, তাই বিবাহের মাধ্যমে সঙ্গী হিসেবে একে-অপরকে পাওয়া জন্য। আবেগের তাড়নায় মানুষ ভালোবাসার কাঙ্গাল তাই ভালোবেসে পাশে থাকার জন্য, পরিবার গঠনের জন্য। নারী পুরুষ বৈধতার সঙ্গে জীবন-যাপন করে সন্তান-সন্ততি জন্মদান এবং লালন পালনের জন্য। বংশ রক্ষা ও পারিবারিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য। বাবা-মাকে সুখে রাখার জন্য। এ ধরনের অসংখ্য কারণ থাকতে পারে তবে, বিবাহ একটি বৈধ শর্তে বৈধ সম্পর্কে জীবন-যাপন করা।
সঠিক পরিকল্পনার অংশ হোক বিবাহ


👉ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে "সৃষ্টিকর্তা স্থাপিত প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ মিলনের মধ্যদিয়ে এক দেহ হয়ে উঠবে এবং যে সন্তান-সন্ততি লাভ করা, স্বামী-স্ত্রী একে-অপরের সুখে-দুঃখে, স্বাস্থ্যে-অস্বাস্থ্যে, বিপদে-আপদে, ধনে-দারিদ্র্যে পাশে থাকার বৈধ পন্থা যা মন্ডলী দ্বারা স্বীকৃত।"বিবাহের গভীরতা মেপে পরিমাপ করা যায় না। বিবাহে নিগুঢ় রহস্য বিরাজমান। বিবাহ শব্দটিকে ভাঙ্গলে তিনটি বর্ণ পাওয়া যায় অর্থাৎ তিনটি শব্দের সমন্বয়ে বিবাহ শব্দটি গঠিত। যেমন- বি+বা+হ= বিবাহ। বিশেষ বাঁধনের হর্ষ বা আনন্দ, বিশেষ বাঁধন ছিন্ন হবে না, বিশাল বাড়ি হবে, বিশেষ বাঁধনে বাঁধা হয়েছে, বিশ্বাসে বাঁধা হলো, বিশেষ বাণী পূর্ণ হলো, বিশেষ বাঁধনে দুইটি হৃদয়।

👉 বিবাহকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে সংজ্ঞায়িত করা যায়। যথা:

"আর তারা দুজনে একদেহ হবে। সেজন্য তারা আর দুই নয় কিন্তু একদেহ। তাহলে ঈশ্বর যা এক সঙ্গে যোগ করেছেন তা মানুষ আলাদা না করুক।" ( মার্ক- ১০ঃ ৮-৯)
👉 সামাজিক দৃষ্টিকোণ-" মানুষ সামাজিক জীব তাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জৈবিক ক্রিয়া সম্পাদনের জন্য প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের এক সাথে থাকার অনুমতি পায়।" 👉 ভৌগলিক মতে- "বিবাহ হলো মানুষ কোন সুনির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমারেখা বা অঞ্চলে বসবাসকালে নারী-পুরুষের বৈধ মেলামেশার সুবিবেচিত মাধ্যম"
বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখা যায়, বিবাহ জীবনের একটি অংশ নয় বরং জীবন ধ্বংসের একটি চেষ্টা। যেখানে সারাজীবন পাশে থাকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় দুটি আলাদা জীবন, সেখানে বিবাহ বিচ্ছেদের স্থায়িত্ব কোনটা দীর্ঘ মেয়াদি আবার কোনটি স্বল্প মেয়াদি হয়। কোন বিবাহ ৮০ বছর সংসার করার পর আবার কোনটি ফুলশয্যা রাতেই বিচ্ছেদের থাবায় আটকে পরে। প্রতিনিয়তই এই ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে সমাজে। (গত এক দশক আগে ৭০ শতাংশ বিবাহ বিচ্ছেদ হতো ছেলেদের পক্ষ থেকে। আর সম্প্রতিকালে ৮০ শতাংশ বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে মেয়েদের পক্ষ থেকে। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন গত ছয় বছরে ৫০ হাজার বিচ্ছেদের আবেদন জমা পরেছে। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের পরিসংখ্যান বলছে সাড়ে ১০ বছরে প্রতি ১০টি বিচ্ছেদের আবেদনে ০৭টি আবেদনই মেয়ের পক্ষ থেকে। বিচ্ছেদের কারণসমূহ হলো নেশা, পর্নোগ্রাফি, মোবাইল, পরকীয়া ইত্যাদি।)
👉 পরিবার কল্যাণের দৃষ্টিকোণ হতে বলা যায়- "বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মিলনের বন্ধনে এক হয়ে উঠার বৈধ শর্ত।" 👉 রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ হতে- "বিবাহ হলো রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা স্বীকৃত বৈধভাবে নারী-পুরুষের মিলন ও রাষ্ট্র রক্ষায় সমভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়।" 👉 প্রেম ভালোবাসার দিক থেকে- "বিবাহ হলো দীর্ঘদিন একে অপরকে চেনা জানার মাধ্যমে এক সাথে থাকার দৃঢ় বিশ্বাস।" 👉 বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে- "একজন নারী এবং একজন পুরুষ যখন বৈধভাবে সহবাসের সুযোগ লাভ করে।" 👉 পারিবারিক দিক থেকে - "দুটি আলাদা পরিবারের ছেলে এবং মেয়ে পারিবারিক স্বীকৃতির ভিত্তিতে এক সাথে থেকে নতুন পরিবার গঠন এবং পরস্পরের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া।"
👉 নারী পুরুষের বৈধভাবে মিলনের একটি স্বীকৃত শর্ত এবং দুটি দেহ ও মনের মিলন।

👉 বিবাহ হলো- "শারীরিক ও মানসিক সুস্থ থেকে নারী পুরুষের এক হওয়ার সম্মতি।" 👉 তাই বলতে পারি "বিবাহ হলো একে-অপরের ভাব বিনিময়ের ফলে রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, সামাজিক আইন দ্বারা স্বীকৃত সুশৃঙ্খলভাবে এক সাথে থাকার অনুমতি।"
যেখানে ভালোবাসা আছে, সেখানে নারী-পুরুষ উভয়ই ছুটে যায়। বিবাহের পূর্বে অবশ্যই শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করে বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ভালো। যার হাত ধরে জীবনের শেষাবধি বেঁচে থাকার অঙ্গীকার, তার হাতটি ধরার পূর্বে তাঁকে জেনে-বুঝে তা করা উচিত। বিবাহ হলো একটি সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার গল্প। যত সামনে অগ্রসর হয়, ততোই তার গভীরতা বাড়তে থাকে। সুতরাং সেখানে ভালোবাসার গভীরতা বেশি। ভালোবেসে যখন হাত ধরেছিলে তবে কেন ছেড়ে চলে যাও? আবেগের মোহে বিয়ের মঞ্চে বসা যায় না। ভালোবাসা থাকলে তার বাঁধন ছিন্ন হবার নয়, আবার সকলে ক্ষেত্রে এ কথা সঠিকও নয়। সমস্যার উদ্ভব হলে ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। ভালোবাসার সাথে জৈবিক ক্রিয়া সমভাবে গুরুত্ব বহন করে। যার কারণে অধিকাংশ বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে থাকে। বিবাহ বিচ্ছেদ হয় এমন সম্ভাব্য কারণসমূহ হলো- নিজের অসম্মতিতে বিয়ে, বিবাহের পূর্বে দেওয়া শর্ত পূরণ না হলে, পুরনো প্রেমে ফেঁসে গেলে, শারীরিক অক্ষমতা থাকলে, সন্দেহ থাকলে ও ভালোবাসার ঘাটতি থাকলে, পরকীয়ায় লিপ্ত হলে এবং সন্তান জন্মদানে অক্ষম থাকলে। তাই সুস্থ দেহ-মনে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ভালো। বিবাহের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সুষ্ঠু পরিকল্পনার অংশ হোক এটাই প্রত্যাশা।

kazolrozario@gmail.com


[  জীবন ও সমাজে   পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ]


Post a Comment

Previous Post Next Post