শিক্ষা ব্যবস্থায় করোনাঘাত ও আমাদের করণীয়

ব্রাদার নির্মল ফ্রান্সিস গমেজ সিএসসি : করোনাঘাত মহামারী আকার ধারণ করেছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই। বদলে গেছে মানুষের জীবন যাপন ও চলাচলের রীতি-নীতি ও অভ্যাস। প্রাণহানীর পাশাপাশি মানুষ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে আর্থনৈতিক ভাবে। ক্ষতির সম্মুখিন সকল পেশা ও কর্মজীবি মানুষ। প্রতিরোধক ও প্রতিশেধক উদ্ভাবনের পূর্বে হয়তো ফিরে আসবে না জীবনের স্বাভাবিকতা। অপরাপর সকল শ্রেণি পেশা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মত অপূরনীয় ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে শিক্ষা আদান-প্রদানে। চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছে সারা বিশ্বের মত আমাদেরও প্রায় পাাঁচ কোটি শিক্ষক-শিক্ষার্থী-শিক্ষাকর্মী (প্রাক্-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা, কারিগরি) এবং তাদের পরিবার পরিজন। অপ্রত্যাশিত এই করোনাভাইরাস অনেক মানুষের প্রাণহানিসহ অপূরনীয় ক্ষয়-ক্ষতির তালিকা উপহার দিলেও ভালো কিছুও কম দেয়নি। বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে উদ্ভূত বর্তমান সমস্যাগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সংবাদ মাধ্যম, সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায়ে চলছে নানা আলোচনা, সমালোচনা, দ্বন্দ্ব, পরিকল্পনা, প্রস্তাব আদান-প্রদান, প্রশ্নোত্তর, সমস্যা সমাধানের নানা বিকল্প সম্ভাবনার প্রস্তাব প্রতিনিয়ত ঘুরছে। তবে সমস্যা যতই ভয়ানক হোন না কেন, ক্ষতির পরিমাণ যতই বেশি হোক না কেন, ক্ষতের পরিমাণ যতই গভীর হোক না কেন, সমস্যা সমাধানের পথ যতই জটিল হোক না কেন, সমাধানের পথ ধরে মানুষ হাঁটবে, এবং অচিরেই আশাব্যঞ্জক এই প্রত্যাশা আমাদের সবারই, সমাধান হবেই। চোখের সামনে ঘূর্ণেয়মান এই বহূল আলোচিত বিষয়গুলোর স্বমন্বিত উপস্থাপন ও আশু সমাধানের সম্ভাব্যতা তুলে ধরাই এই লেখনির ক্ষুদ্র প্রয়াস। 

করোনাঘাতে শিক্ষায় নেতিবাচক আলোচনা

সব বন্ধ : ১৭ মার্চ থেকে হঠাৎ করেইে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধের পূর্বে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোন সময় দেওয়া হয়নি শিক্ষার্থীদের কোন দিক নির্দেশনা দিয়ে পাঠাতে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সকলেই হয়তো মনে করেছে এখন সব বন্ধ তাই পড়ালেখাও বন্ধ। কিন্তু এই বন্ধ যদি দীর্ঘ হয় তবে শিক্ষার্থীরা কি, কিভাবে এবং কতটুকু কাজ বাড়িতে বসে করবে তার কোন নির্দেশনা দেওয়ার ও নেওয়ার সুযোগ হয়নি। একটি অনিশ্চয়তা নিয়ে সকলেই সাধারণ ছুটিতে গেছেন। কিছুদিনের মধ্যেই একটা আত্মোপলব্ধী আসতে শুরু করেছে, যদি দু-তিন দিন সময় পাওয়া বা নেওয়া যেতো তবে কতই না ভালো হতো।  

হারিয়েছে জীবনের শৃংখলা ও গতি : অনিশ্চিত ছুটির মধ্যে সামাজিক ও পারিবারিক বাস্তবতার কারণেই শিক্ষার্থী প্রথম দিকে তার শিক্ষা জীবনের দৈনন্দিন অত্যাবশ্যক শৃংখলাগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ছাড় দিতে শুরু করেছে, যেহেতু প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় কোন নির্দেশনা দিয়ে ও নিয়ে ছুটি শুরু করা যায়নি। কমতে শুরু করেছে কর্মের ও জীবনের গতি, ভালো না লাগা থেকে ধীরে-ধীরে বেড়ে গিয়েছে অযথা সময় নষ্ট করার প্রবণতা, পিতা-মাতা ও গুরুজনের অবাধ্য হবার মত অপ্রত্যাশিত আচরণ, দৃশ্যমান হয়েছে উদ্ভট কিছু আচরণ যা আগে কখনো হয়তো দেখা যায়নি যা পুনরুদ্ধার অনেকটা কঠিন হবে বলেই সামনের দিনের আশংকা। 

করোনাবন্দি পাবলিক পরীক্ষা : আভ্যন্তরিন নিয়মিত পরীক্ষাগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম, বন্দি হয়ে পড়েছে প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পাবলিক পরীক্ষাগুলো। সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পড়ে গেছে অপূরণীয় সেশন জটে। চরম অনিশ্চয়তায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সকলে। বিলম্বিত হবার আশু সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে পরবর্তী শ্রেণি, পর্যায় ও সেশন শুরুর বিষয়টি। হতাশা-নিরাশা আছড়ে পরেছে শিক্ষার্থীর হৃদয়ে, পড়ালেখার আগ্রহ, মনোবল, অধ্যবসায় হারিয়ে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো সময়। হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের মন্থর গতিও।

মানসিক বিপর্যয় ও সামাজিকীকরণে বাধা : ঘরবন্দি শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত পরিবেশের কারণে, গণ্ডীবদ্ধ স্থানে অসহনীয় পরিবেশে বসবাস ক’রে, উদ্বুদ্ধ ও সঙ্গত হতাশাজনক পরিবেশে, পারিবারিক অসন্তুষ্টি, বিবাদ ও অর্থনৈতিক সংকটাবস্থা দর্শনে নানাভাবে মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। মনোজগতে শিক্ষার্থীর উপর পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব যা তার আবেগে, আচরণে ও কর্মে নেতিবাচকরূপেই বহিপ্রকাশ ঘটছে। এর পাশাপাশি বন্দিঘরে ছোট্ট পরিসরে দীর্ঘকাল অবস্থানের কারণে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, নীতি-নৈতিকতা, নিয়ম-কানুন, দায়িত্ব-কর্তব্য ও সহভাগিতা-সহযোগিতার চর্চাহীনতায় সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সামাজিকীকরণের মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।    

শিশু নির্যাতন ও বাল্য বিবাহ : যেহেতু বন্দি জীবনে উপরোক্ত অবস্থাগুলো শিক্ষার্থীদের জীবন বিষিয়ে তুলছে এবং আচরনণক নেতিবাচক প্রবণতাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে, সেহেতু পিতা-মাতা, অভিভাবক বা পারিবারিক অপরাপর দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ অনেক সময় তাদের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় হাপিয়ে যাচ্ছেন। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অভিভাবক শ্রেণির অনিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়ায় তাদের উপর নেমে আসছে শাসনের নামে নির্যাতন-নিপীড়ন। অন্যদিকে ঘরবন্দি নিকটাত্মীয় বা অন্য কারো সাথে নানা অপ্রত্যাশিত কিংবা অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী শিক্ষার্থীরা। অনন্যোপায় হয়ে বা অভাবের তাড়নায় কিংবা পরিবেশের কারণে বিশেষ করে অপ্রাপ্ত বয়সী কিশোরীকে দেওয়া হচ্ছে বিয়ে যা জাতি ও সমাজকে আবারো পিছনের দিকে টেনে নামাচ্ছে। 

বখে যাওয়া : দেশের সকল জায়গায় করোনার প্রাদুর্ভাব এক রকম নয়, যেখানে বেশি সেখানে হয়তো কোন না কোনভাবে অভিভাবক শ্রেণি বেশিরভাগ সময় সন্তানকে ধরে বেধে ঘরেই রাখছেন এবং মোটামুটি উচ্ছন্নে যাওয়ার হাত থেকে সুরক্ষা করতে পারছে। কিন্তু যে সকল এলাকায় সমস্যাটা প্রকট নয় সেখানে শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই লাগামহীন ঘোড়া! আবার অতি আদুরে সন্তান, বয়সে একটু বড় হয়েছে, শাসন করার মত অভিভাবক হয়তো কাছে থাকেন না এমন শিক্ষার্থীদের অনেকেই নিজ স্বাধীনতা ব্যবহারের কৌশল হিসেবে অভিভাবককে ধমক দিয়ে, নানাভাবে জিম্মি করে, অবাধ্য হয়ে বা কোন খোড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইচ্ছে ঘুড়ির খেয়াল-খুশিতে। দিনে-দিনে পরিবর্তন হচ্ছে তার অভ্যাস, রুচি, আচরণ ও জীবন। এক কথায় বখে যাচ্ছে অনেকেই। 

ঝরে পড়ার আশু সম্ভাবনা : আজ পর্যন্ত শুধু ঢাকা শহর ছেড়ে নাকি প্রায় পঁঞ্চাশ হাজার পরিবার সব কিছু নিয়ে গ্রামে চলে গেছে, অচিরেই আরো কত মানুষ শহর ছাড়বে কে জানে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও ইতিমধ্যে চাকুরী হারিয়েছে প্রায় দু’কোটি মানুষ, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উপার্জন ও আর্থিক সক্ষমতা, পারিবারিক আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে অনেক পরিবার বিভিন্ন শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে গ্রামের বাড়িতে, অনেকে বদলাচ্ছেন পেশা, কবে তারা চাকুরী ফিরে পাবে, কবে তারা আবার আসবে শহরে নিজের স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি একটি ছোট্ট বাসায়? অনেক শিশু কিশোর ও যুবারা পরিবার ও নিজেকে বাঁচাতে নেমে পড়ছে জীবন যুদ্ধে জীবিকার সন্ধানে, তারা কি সহসা ফিরে আসতে পারবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে? প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল স্তরেই বেড়ে যাচ্ছে ঝরে পরার চরম হুমকী। ছোটরা কিছুকাল বিরতির পর ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলেও তুলনামূলকভাবে বড়দের সম্ভাবনা ক্ষীণ।  

নেট/প্রযুক্তির অপর্যাপ্ততা : পরিস্থিতি মোকাবেলায় শিক্ষার্থীদের মঙ্গলার্থে সরকারীভাবে সীমিত আকারে টেলিভিশনে আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে (খুব সীমিত সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে) ভার্চ্যুয়াল ক্লাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এখনো রাষ্ট্রিয়ভাবে ইন্টারনেটের সুবিধা সকলের কাছে পৌঁছেনি আবার যেখানে পৌঁছেছে সেখানে সকলের আর্থিক সামর্থ নেই তার প্রয়োজনীয় উপকরণাদির আয়োজনের। সেক্ষেত্রে প্রদেয় ও সম্ভাব্য সুবিধা একটা বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী গ্রহণ করতে ব্যর্থ। একদিকে তারা সঙ্গত কারণে বঞ্চিত অন্যদিকে বঞ্চনার ব্যথায় মর্মাহত ও হতাশায় নিমজ্জিত চলমান সময়ে ঘটে যাওয়া ক্ষতিগুলো অনাগত ভবিষ্যতে সে কিভাবে মোকাবেলা করবে ও পুষিয়ে নিবে সেই ভাবনায়। 

নেটাসক্তি : আবার বেশ ভালো একটা সংখ্যা যারা ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে, পারিবারিক ও আর্থিক সুবিধার কারণে ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করছে। কেউ-কেউ উক্ত সুবিধার যথাযথ ব্যবহারে প্রকৃতপক্ষে উপকৃত হলেও তাদের মধ্যে অনেকে অনলাইন ক্লাশের সুবাদে অভিভাবকের ফেইসবুক ব্যবহার করছে অথবা নিজের আইডি খুলে নিয়েছে। কেউ-কেউ অভিভাবককে বোকা বানিয়ে নিজের জন্য ডিভাইস দাবী করে আদায় করে নিয়েছে, আবার অনেকে অভিভাবকের ডিভাইসটি অনলাইন ক্লাশের অজুহাতে দিনের সিংহভাগ সময় নিজের কাছে রেখে যথেচ্ছা ব্যবহার বা অপব্যবহারে রত আছে। এভাবে নানা কারণে নানা অজুহাতে, নানা কৌশলে অনেক শিক্ষার্থী নানা বাজে সাইটে আসক্ত হয়ে পড়ছে, কে, কবে, কিভাবে তাকে আগামী দিনে সেই অবস্থান থেকে ফিরিয়ে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে জানি না। আগামী দিনে এটি হতে পারে সকলের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ।   

সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষকের মধ্যে বৈষম্যমূলক পরিস্থিতি : শিক্ষা প্রতিটি মানুষের/শিশুর মৌলিক ও মানবাধিকারের বিষয়, যা প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক হবার কথা থাকলেও দেশে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুপাতে আধা-সরকারী বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বেশি। অন্যদিকে করোনার মহামারীর সময়ে সরকারী ও আধা-সরকারী (আংশিক) শিক্ষকগণ নিয়মিত বেতন পেলেও আধা-সরকারী (অধিকাংশ) ও বেসরকারী শিক্ষকের অবস্থা দুঃখজনক। যেহেতু সকল মানুষের আয় উপার্জন ক্ষতিগ্রস্ত তাই অনেক প্রতিষ্ঠান/শিক্ষক অভিভাবকদের দ্বারা আইসোলেশনে আছেন, এমনকি কোথাও কোথাও ভেন্টিলেশনে আছেন। 

অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব : দেশে আধা সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিষ্ঠান এবং অভিভাবক শ্রেণীর মধ্যে বিরাজ করছে চরম টেনশন, টানাটানি ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব। কারো ধারণা, ‘বেতন দিতে হবে না সরকার দিবে’, ‘ক্লাস না হলে বেতন নিবে কেন বা দিব কেন’, ‘আপনারা না দিলে শিক্ষকগণ চলবেন কিভাবে’, এধরণের নানা মন্তব্য, বক্তব্য, আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। এই অবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ভালোভাবে টিকে থাকতে না পারে তবে বর্তমানে এবং আগামী দিনে শিক্ষার্থীরা পড়তে পারে চরম ভোগান্তিতে। এই বিষয়গুলো শিক্ষকের মর্যাদায়ও হানছে লজ্জাজনক আঘাত। 

অ-দক্ষতার প্রমোশনের সম্ভাবনা : যদি এবছর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যায়, ‘তবে সিলেবাস কমিয়ে পরীক্ষা নেওয়া’, ‘না হয় আগামী বছরের দুই-তিন মাস এবছরের শিক্ষাবর্ষে নিয়ে সময় বাড়িয়ে নেওয়া’, ‘আর ফিরে আসা না গেলে সকলকে অটো-প্রমোশন দেওয়া’ এ ধরনের নানা সম্ভাবনার কথা ভাবা হচ্ছে, বলা হচ্ছে, খবরে ভাসছে। যেটাই করা হোক না কেন, জ্ঞানের ধারাবাহিক অগ্রযাত্রার কথা চিন্তা করলে এই সকল অবস্থায় শিক্ষাবর্ষ শেষ হলে আগামী বছর পরবর্তী শ্রেণির বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীগণ বুঝবে কিভাবে? যারা তুলনামূলকভাবে স্বল্প মেধা সম্পন্ন তারা এই কঠিন অবস্থা সামাল দিবে কিভাবে? যে সকল বিষয়ে ব্যবহারিক শিক্ষার বিষয়টি জড়িত সে ক্ষেত্রে অদক্ষ একটি গ্রুপ সামনে যাবে। সব কিছু মিলিয়ে অ-দক্ষ, অপ্রস্তুত অবস্থায় প্রমোশন দিয়ে সবাইকে বিপদে ফেলে দেওয়ার একটি সম্ভাবনা খুব আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

আসবাবপত্র ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ স্কুল বিক্রি হবে : অতি দুঃখজনক যে কোথাও কোথাও বিজ্ঞাপন ঝুলছে ‘আসবাবপত্র সহ স্কুল বিক্রি হবে’! আমরা বুঝতে পারি কোন অবস্থায় প্রতিষ্ঠাতা, পরিচালক বা মালিক যা-ই বলিনা কেন তারা এই বিজ্ঞাপন দিতে পারেন। হয়তো কাল দেখবো, শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং আসবাবপত্র সহ বিদ্যালয়/কলেজ/বিশ্বিবিদ্যালয় বিক্রি হবে। যদি তাই হয়? যদি বিক্রি না হয়, যদি চালানোও সম্ভব না হয় তবে কি হবে? হয়তো বন্ধ হবে! তবে যে শিক্ষার্থীগণ ঐ প্রতিষ্ঠানগুলোতে আছেন তারা কোথায় যাবে? যারা আজ বেতন দিতে চাচ্ছেন না তারা সন্তান নিয়ে কোথায় যাবেন? আদালতে? সমাধান কবে হবে? আমার এত্তসব কিছু জানা নেই।


করোনাঘাতে শিক্ষায় ইতিবাচক আলোচনা

পরিবারিক নৈকট্য ও বন্ধন দৃঢ়করণ : জীবন-জীবিকার যুদ্ধে, সঙ্গত বাস্তবতার কারণেই কতকাল পরিবারের সবার সাথে সবার পর্যাপ্ত সময় দেওয়া-নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি! এমনকি পরস্পরকে ভালো মত চেনা-জানাও হয়নি। করোনা-লকডাউন ফিরিয়ে দিয়েছে পরস্পরকে আবার কাছাকাছি। সুযোগ হয়েছে পিতা-মাতা পরস্পরের আর সন্তানের সাথে তাদের সম্পর্ক দৃঢ় করতে। একে অপরকে আরো নিবিড়ভাবে জানতে, সন্তানের সম্ভাবনা, প্রবণতা, আবেগানুভূতি, পছন্দ-অপছন্দ, গতি-প্রকৃতি বুঝতে ও সেইভাবে নিজের মনমতো তাকে গড়ে তোলার সুযোগ যা এতো কাল সময় ও সুযোগের অভাবে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটলেও বেশিরভাগ সন্তানের সাথে এ সময়ে পিতা-মাতার বন্ধন আরো গভীর ও দৃঢ় হবারই কথা যা তাদের সকলের কাছে চিরকাল অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে। 

নিজের সুপ্ত প্রতিভাগুলোর বিকাশের সুযোগ : সন্তানকে এ কয়দিনে আবিষ্কার করে পিতামাতা নিশ্চয় তাদের সুপ্ত প্রতিভা ও সম্ভাবনাগুলো বুঝে গেছেন। এবার নিজের হাতে সেগুলো ঘষে-মেজে অনুশীলন করিয়ে ক্ষুরধার করতে পেরেছেন। ক্লাশ, কোচিং আর বইয়ের অসহনীয় বোঝা সন্তানের কাঁধে নেই, নেই পরীক্ষা নামক পেষণের চাপ। চাপহীন মুক্তমনে শিক্ষার্থীরা শিখে নিতে পারছে নিজের পছন্দের বিষয়গুলো যেমন, ভিন্ন ভাষা, অঙ্কন, গান, বাজনা, লিখন, আবৃত্তি, পড়া আরো কত কি! সময়গুলো কাজে লাগাতে পারলে এ কয়েক মাস পর সে তার নিজের প্রতিভায় প্রস্ফুটিতই হবে। 

শিখন ফলের প্রায়োগিক অধ্যায় : প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি শ্রেণিতে সিলেবাসের অন্তরালে রয়েছে শিখন ফলের সমাহার। পাঠ্য বিষয়ের গভীরে রয়েছে মূল্যবোধ ও আচরণের পরিবর্তনের গুপ্তধন। শিক্ষক নামের জীবন গুরু পাঠদানের সাথে-সাথে প্রতিনিয়ত তাকে দিচ্ছেন মূল্যবোধের ভান্ডার। পরিবারে পিতা-মাতারও রয়েছে নিজ সন্তানকে নিয়ে কত বড় বড় স্বপ্ন যাকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত নিজের রক্তের বিনিময়ে তিলে-তিলে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় নিজেকে নিশেষ করে চলেছেন তারা। এবার ঘরে অঢেল সময়, নিজের সন্তানকে পর্যবেক্ষণ করার, এতকাল সে যা শেখানো হয়েছে, সে যা শিখেছে সেগুলো তার জীবনে প্রয়োগের মাত্রাটা কতটুকু তা দেখে নেবার, পরিমাপ করে নেবার, সংশোধন করে দেবার। এখনই সময় নিজের মনের মত করে তার সাথে যাত্রা করে ইতোমধ্যে অর্জিত মূল্যবোধগুলো ব্যবহারিক জীবনে অভ্যস্ত করে তোলা।  

ভার্চুয়াল কলা-কৌশলে পারদর্শিতা : লকডাউনের পূর্বে বলতে গেলে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক তেমন কেউই ভার্চুয়াল কলাকৌশলে পারদর্শি ছিলনা। অথচ সময়ের দাবী পূরণ করতে গিয়ে নিজের দায়বোধ থেকে শিক্ষক অভ্যস্ত হচ্ছেন ক্লাশ নিতে, অভিভাবক অভ্যস্ত হচ্ছেন সন্তানের জন্য ক্লাশগুলো অনুসরণ করার সকল ব্যবস্থাকরণে এবং শিক্ষার্থী নিজেও দক্ষ হচ্ছে দৈনিক পাঠদান গ্রহণে। যার টেলিভিশন ছিলো না তিনি তা কিনেছে, যার এনড্রয়েড মোবাইল ছিল না তিনি তাও কিনেছেন, যার নেট ছিল না তিনিও নেটের আওতায় আসলেন আর যার ফেইসবুক ছিল না তিনিও সন্তানের জন্য একটি আউডি খুলে নিয়েছেন, এছাড়া অন্যান্য অ্যাপসগুলোতে আছেই। উক্ত করোনা পরিস্থিতি কত মানুষকে তথ্য-প্রযুক্তির আওতায় এনেছে তার হিসেব নেই। কত মানুষকে তা ব্যবহারের কলাকৌশলে দক্ষ করে তুলেছে তা অভাবনীয়। আজ বিশেষতো বটেই, আমরাও জাতি হিসেবে এক লাফে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে আরো অনেক ধাপ এগিয়ে গিয়েছি।

মানবিকতার চর্চা : করোনাঘাতে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের প্রতিটি মানুষের মাঝে নেমে এসেছে মৃত্যুর ভয়াতঙ্ক, হতাশা, দারিদ্র্য, কুসংস্কার সর্বোপরি মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিক আচরণের প্রদর্শনী। এই অবস্থায় সকলের জন্য সুযোগ এসেছে নিজ বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও মানবিকতার চর্চা করার। মৃত্যুর ভয়ে আতঙ্কিত ব্যক্তির পাশে দাঁড়ানো, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবারের সাহায্যে কাজ করা, আয় উপার্জনের মাধ্যম হারানো ব্যক্তি ও পরিবারের সাথে সহভাগিতা করা, করোনা রোগ-রোগী ও মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফন নিয়ে যে কুসংস্কার ও অমানবিক আচরণ চারিদিকে অমানবিকতার বিষ ছড়াচ্ছে যেখানে সমব্যাথী হয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া এবং উক্ত অভিশপ্ত সামাজিক পরিবেশকে সুস্থতা দান সময়ের দাবী ও তা ব্যবহারের সুন্দর সুযোগের স্রোত বয়ে যাচ্ছে।

আধ্যাত্মিকতায় বলিয়ান : ‘কর্মই ধর্ম’, ‘নিজের দায়-দায়িত্ব ঠিকমত পালন করাই ধর্ম পালন করা’ ইত্যাদি নানা যুক্তিতে জীবনভর মানুষ কর্মব্যস্ত হয়ে জীবন কাটায়, জীবনের কোন এক পর্যায়ে এসে আত্মোপলব্ধী হয় আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো কতই না অবহেলিত রয়ে গিয়েছে। তখন হয়তো হাতে আর সময়ও থাকে না। অনুতাপের অনুভূতি নিয়ে চলে যেতে হয় পরপারে। করোনাকালীন সময়ে সকলের জন্য বড় একটা আশীর্বাদের সময় এসেছে নিজ-নিজ বিশ্বাস মতে অবহেলিত আধ্যাত্মিক জীবনে আরো বলিয়ান হয়ে ওঠা, সৃষ্টির প্রতি আমাদের দায়-দায়িত্বগুলো সম্পর্কে কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা এবং স্রষ্টার প্রতি আস্থা ও নির্ভরতা বাড়িয়ে তোলা।  

স্রষ্ট, সৃষ্টি ও মানব কর্মের গভীরে যাত্রা : করোনা এক বার্তা নিয়ে এসেছে, ‘ভেতরে যাও, গভীরে যাও’। প্রথমত স্বাস্থ্য বিধিমতে আমাদের বলা হয়েছে ‘লকডাউন, ঘরে থাকুন’ অর্থাৎ ভেতরে যাও। বাইরের পরিবেশটাকে দূষণের ফলে, ধ্বংসের ফলে, ভোগের ফলে প্রায় বাস অযোগ্য করে তুলেছিলাম আমরা, এবার প্রতিক্রিয়া এসেছে বাঁচতে হলে ভেতরে থাকার। দ্বিতীয়ত আমাদের কাছে আহ্বান এসেছে, ‘গভীরে যাও’, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব মানুষ হিসেবে ধরিত্রী মাতা ও তার প্রকৃতির উপর আমাদের মানবিক দায়িত্ব কতটুকু নিষ্ঠার সাথে পালন করেছি, ভোগ-বিলাসিতা ও সুবিধাবাদের জন্য কতটুকু অবহেলা করেছি তা নিয়ে আত্মোপলব্ধীর গভীরে যেতে। আরো বেশি গভীরে যেতে আহ্বান এসেছে যে, মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি, অনুসন্ধান-আবিষ্কার, আর্থিক-রাজনৈতিক-সামরিক-ক্ষমতার উর্ধ্বে একজন রয়েছেন, তাঁর ওপর বিশ্বাসে জীবন যাপন করতে এবং তিনিই যে সকলের জীবনের মালিক, তা রক্ষা ও ধ্বংসের ক্ষমতাও তাঁর হাতেই এই উপলব্ধি থেকে জীবনের ও আচরণের পরিবর্তনের মাধ্যমে জীবনের গভীরতায় গিয়ে শুদ্ধাচারণের আহ্বানের গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ নিয়ে করোনা এসেছে জগতে অবাঞ্ছিত অতিথি হয়ে। করোনা আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ তা করোনা কালের অবসানেই বোঝা যাবে। 

করোনাঘাত হতে শিক্ষা ব্যবস্থার উত্তরণ প্রসঙ্গ 

উদার, ন্যায় সঙ্গত ও মানবিক দৃষ্টি ভঙ্গি : সাফ কথা, করোনাঘাতে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ আছে, কোথাও-কোথাও শিক্ষকগণ ভার্চ্যুয়াল ক্লাশ নিচ্ছেন, রাষ্ট্রিয়ভাবে টেলিভিশনের বা অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাশ নেওয়ার প্রয়াসে কার্যক্রম চলছে, শিক্ষকের কোচিং/প্রাইভেট টিউশন বন্ধ। এমতাবস্থায় সরকারী শিক্ষক বা শিক্ষা কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বেতন নিয়মিত পেলেও আধা সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সামর্থ অনুযায়ী পূর্ণ বেতন বা আংশিক বেতন দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। আবার দুঃখজনক হলেও সত্য কোথাও-কোথাও তা বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষকতা এমন একটি জীবন স্বাক্ষ্যদানকারী ও সম্মানজনক পেশা, তারা চাইলেও অন্য যে কোন পেশা বা মাধ্যমে উপার্জনে নেমে পড়তে পারেন না, যদিও জীবনের দায়ে অনেকেই তা করতে বাধ্য হচ্ছেন। শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকমণ্ডলী নিশ্চয় দেখতে চাইবেন না তাদের শিক্ষাগুরু হেন একটি পেশায় নিজে উপার্জন করে সংসার ও জীবন চালাচ্ছেন।

বর্তমান অবস্থার মোকাবেলায়, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা ব্যক্তি পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের অবশ্যই বিবেচনায় আনা আবশ্যক কিভাবে শিক্ষার্থীকে নানাভাবে (ভার্চ্যুয়াল ক্লাস, নিয়মিত যোগাযোগ ও পরামর্শ দান, ইন হাউজ পড়াশুনা ও পরীক্ষায় সহায়তা করা, পরিবারের নানা সঙ্কটে পাশে থাকার মানবিক সমর্থন যোগানো ইত্যাদি) সহায়তা করা যায় এবং শিক্ষক কিভাবে সম্মান নিয়ে টিকে থাকতে পারেন। যে সকল প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সামর্থ আছে, যতদিন আছে, শেষ দিন পর্যন্ত উদার, ন্যায়সঙ্গত ও মানবিক দৃষ্টি নিয়ে শিক্ষকের পাশে দাঁড়ানো জরুরী। অন্যদিকে প্রতিটি পরিবারের কথা মাথায় রেখে শিক্ষার্থীকেও বাস্তবসম্মত আর্থিক ছাড় দিয়ে ঝরে পড়া থেকে রক্ষা করতে হবে। আবার, অভিভাবকদেরও একই মনোভাবে বলিয়ান হয়ে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের পাশে দাঁড়ানো সময়ের দাবী। করোনার অজুহাতে সামর্থ থাকতেও শিক্ষকের বেতন কমিয়ে দেওয়া বা বন্ধ করে দেওয়া যেমন রাষ্ট্র, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, ও কোন ব্যক্তির জন্য ন্যায় বর্জিত হবে, ঠিক তেমনি অভিভাবকদেরও এ সময়ে সন্তানের গঠনদাতা সম্মানিত শিক্ষকের কথা চিন্তা না করে নানা যুক্তি দাঁড় করিয়ে অসহযোগিতার অবস্থান নেওয়া ন্যায়সঙ্গত হবে না। জাতীয়ভাবে উদার, ন্যায়সঙ্গত ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা আজ আশু প্রয়োজন।

পারস্পরিক সহানুভূতি : পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহানুভূতি ছাড়া শিক্ষার এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লাখ-লাখ শিক্ষকের কথা, শিক্ষা পরিবারের প্রায় পাঁচ কোটি সদস্যের কথা, কোমলমতি শিক্ষার্থী যারা এবছরের অপরিপূর্ণ শিখন ফল নিয়ে আগামীতে উচ্চতর শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবে তাদের নানা দিকের কথা, অভিভাবক তথা জনগণের আয় উপার্জনের দুরাবস্থার কথা। পাশাপাশি শিক্ষা পরিচালনাকারী সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গকেও গভীরভাবে ভাবতে হবে শিক্ষার সাথে জড়িত পরিবারগুলোর বাস্তবতার কথা। অন্যদিকে শ্রদ্ধেয় অভিভাবকদেরও ভাবা প্রয়োজন সন্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক যেন টিকে থাকে এবং দুর্যোগকাল শেষে খুশি মনে, পুরো ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং উদ্যম ও গতি নিয়ে সন্তানের জীবন থেকে ক্ষয়ে যাওয়া অতি মূল্যবান সময় ও লোকসান পুষিয়ে নেয়ার জন্য অকৃপণভাবে আত্মনিয়োগ করার প্রেরণা পান । উভয় শ্রেণির সক্ষমতা ও অপারগতার বিষয়গুলো বিবেচনা করে পারস্পরিক সহানুভূতিশীল অনুভূতির দায়িত্বশীল মিথক্রিয়ায় হয়তো সম্ভব করোনা শেষে সকল ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশা করা। যে যার যুক্তিতে অবস্থান নিলে, নিজের দাবী ও সুবিধা আদায়ের কথা ভাবলে, সামর্থ থাকতেও অপরকে বঞ্চিত করার মনোভাব ধরে রাখলে, বর্তমানে ঘটে যাওয়া ক্ষতিগুলো আগামী দিনে পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যেতে পারে। 

যোগাযোগ বৃদ্ধি ও কাউন্সেলিং : এত লম্বা সময় বন্দি জীবন, হাতে কাজের তালিকা নেই, নেই পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত ও  শিক্ষাদানে অভ্যস্ত, দক্ষ শিক্ষক, বাবা-মায়ের শাসন কিংবা অতি শাসন বা বিষয় জ্ঞানের অনভ্যস্ততা ও অপারদর্শিতায় সৃষ্ট বিরক্তি, কোন-কোন ক্ষেত্রে তার উপর সৃষ্ট শারীরিক বা মানসিক চাপ এবং নির্যাতন, পরিবারে আর্থিক সঙ্কট সৃষ্ট বড়দের কলহ, কর্মহীন লম্বা অলস সময় ব্যবহারে অনভিজ্ঞতা, সামনে পড়ালেখার কি হবে, পরীক্ষা কবে হবে, সিলেবাস কিরূপ হবে, সহপাঠিদের সহযাত্রার অভাববোধ, পরিবারে সহায়তা করতে উপার্জনের চাপ, কোন কোন ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের চাপ, যৌন নির্যাতনের শিকার ইত্যাদি আরো অসংখ্য পরিস্থিতির শিকার শিক্ষার্থীরা। তাদের মানসিকভাবে ভারসাম্য রাখতে, আশু পরিস্থিতিতে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে ও মোকাবেলা করতে শিক্ষকগণের নিয়মিত যোগাযোগ, উপদেশ, পরামর্শ ও পরিচালনা এ মুহূর্তে অতীব জরুরী। এসময়ে শিক্ষার্থীদের পাশে শিক্ষক আছেন, তার যাত্রায় শিক্ষক সহযাত্রী, তার দুঃখ ও সমস্যায় শিক্ষক সমব্যাথী এ জাতীয় উপলব্ধি নিজেকে অনেকটা সামলে নিতে সহায়তা করতে পারে। যদিও শিক্ষক নিজেও করোনাঘাত মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছেন, তারও পরিবার-পরিজন আছে, তারও জীবনের হূমকী রয়েছে, তারও আর্থিক সঙ্কট আছে, ব্যক্তি ও পরিবার হিসেবে তিনিও অপরাপর সকলের মতোই সমস্যাগুলো মোকাবেলায় প্রায় ক্লান্ত তবুও মানুষ গড়ার পবিত্র ব্রত হিসেবে শিক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে তার পাশে থেকে প্রয়োজনীয় কাউন্সিলিং সেবাদানে প্রায় ভেঙ্গে পড়া শিক্ষার্থীকে সহায়তা করা জরুরী। 

চরম ও কঠোর পরিশ্রমের জন্য মানসিক প্রস্তুতি : করোনা পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে কে জানে? সকলেরই প্রত্যাশা-প্রার্থনা তারাতারি হোক। তবে তা যখনই হোক, ঘটে যাওয়া শিক্ষাবর্ষের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হয়তো নীতি নির্ধারকগণ দ্রুততম সময়ে তুলনামূলকভাবে ছোট্ট সিলেবাসে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন ও আগামী বছরের জন্য উত্তীর্ণের ব্যবস্থা করতে পারেন। সে যাই হোক, বর্তমান শিক্ষাবর্ষ কোন মাস পর্যন্ত হবে? সপ্তাহে কতদিন ক্লাস হতে পারে? দৈনিক কতঘণ্টা নিজে পড়াশোনা করলে কাঙ্খিত শিখন ফল অর্জন করা যেতে পারে? পরিক্ষা কয়দিনে সমাপ্ত হবে? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন এখন ভীড় করছে শিক্ষার্থীর মনে। কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যখন পাওয়া যাবে তখন শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী সকলকেই চরম ও কঠোর পরিশ্রমের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। যে কোন দুর্যোগ মোকাবেলার সময় মাপকাঠি দিয়ে পরিমাপ করে পরিশ্রম করা যায় না।  

সম্ভাব্য করোনা ঘাটতি বাজেট : শিক্ষাবর্ষের হারিয়ে যাওয়া আলোচিত সময়গুলো যদি পুষিয়ে নিতেই হয়, আর্থিক সংকট ও দ্বন্দ্বগুলো যদি পারস্পরিক সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও মানবিকতার মাধ্যমে সমাধান না হয়, তবে আগামী দিনে সময় ও অর্থের ঘাটতি ও ক্ষতিপূরণের একটি বাজেট যুক্তিসঙ্গত কারণেই আসতে পারে যদিও এবারের জাতীয় বাজেটে তা তেমনভাবে প্রতিফলিত হয়নি। তাই মানবিক দৃষ্টি নিয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব, এখনই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সহানুভূতিশীল কর্ম পদক্ষেপ নিয়ে বাস্তবায়ন করা, প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের পারস্পরিক অসুবিধাগুলো বিবেচনা করে তাদের একটা যুক্তিসঙ্গত অবস্থানে পৌঁছানো জরুরী, যেন করোনা ঘাটতি বা ক্ষতিপূরণের বাজেটের চাপে পড়তে না হয়।  

উপসংহার : করোনা লাখ-লাখ মানুষকে জীবন নিয়েছে, সব মানুষের জীবন নাশের হুমকী দিয়েছে আবার জীবনের গভীরে প্রবেশ করে বিশ্ব সৃষ্টি ও স্রষ্টার উপর অনেক সত্যানুভূতি  জাগরিত করেছে। এই পরিস্থিতিতে ভিন্ন-ভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজ নিজ জীবন জীবিকায় আত্কে উঠেছে, ক্ষতির শিকার হয়েছে, মুচড়ে পরেছে। ঠিক একইভাবে শিশু কিশোর ও যুব শ্রেণি যারা শিক্ষাকালীন জীবনে আছেন এমন বহু কোটি শিক্ষার্থী, সুনির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষাজীবন শেষ করতে না পারার হুমকীতে আছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক অর্থনেতিক মন্দার কারণে শিক্ষা জীবনে ফিরে আসার অনিশ্চয়তায় আছে। ক্ষয়ে যাওয়া সময় ও ক্ষতি পূষিয়ে নেওয়ার মতো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার উপায় দায়িত্বশীলদেরই নিতে হবে। সময়োপযোগী বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত এবং শিক্ষক-অভিভাবকের সমন্বিত সহযোগিতাই হয়তো পারবে আমাদের এই শিক্ষা পরিবারের হতাশা দূর করে আগামী দিনের সু-নাগরিকদের গুণগত মানের জীবন গঠনের নিশ্চয়তা দিতে। আর বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নিবে নাইবা কেন, শিক্ষাই যে একটি জাতির জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ। আগামী দিনের জাতি কেমন হবে তা নির্ভর করছে আমাদের আজকের গৃহিত সিদ্ধান্ত ও শিক্ষা ব্যবস্থার উপর। আলোচিত সকল পক্ষ সমন্বিত আন্তরিক প্রচেষ্টা করলে তা অবশ্যম্ভাবী।   

পূর্বপ্রকাশ
সাপ্তাহিক প্রতিবেশী সংখ্যা:২৪ ও ২৯, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ

Post a Comment

Previous Post Next Post