জাসিন্তা আরেং
করোনাকালে বিশ্বের সকল আদিবাসীদের জীবনে যেন এক অনাকাক্সিক্ষত স্থবিরতা নেমে এসেছে। যার ফলশ্রুতিতে আদিবাসীদের আর্থসামাজিক জীবনে বেশ প্রভাব পড়েছে। আইএলও এর জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠি মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের ফলে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছে। তারা প্রায় সকলেই করোনায় আক্রান্ত না হয়েও করোনার সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে এবং মানবেতর জীবন-যাপনে বাধ্য হচ্ছে। যেহেতু আদিবাসীদের বেশিরভাগ লোকই অভাব-অনটন এবং দারিদ্র্যে জর্জরিত, এই করোনাকালে তাদের অবস্থা শোচনীয় এবং অবর্ণনীয়। কোভিড-১৯ এর ফলে আদিবাসীরা কর্মহীন হয়ে পড়ায় খাবার, চিকিৎসা এবং ওষুধপত্র কিনতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বলা যায় যে, তারা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। তাছাড়া যারা বিভিন্ন সবজি, ফলমূল উৎপাদন করে এবং পাহাড়ী বন থেকে জ্বালানি কাঠ কেটে বাজারজাত করার সাথে সম্পৃক্ত, তাদের শতকরা ৮৫ ভাগই সামাজিক সুরক্ষার বাইরে অবস্থান করছে। ভাষা ও সংস্কৃতিগত ভিন্নতা এবং তাদের মাতৃভাষায় সুরক্ষা বিষয়ক জ্ঞানের কমতি থাকার ফলে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রেও বিঘেœর সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে, প্রত্যন্ত এলাকায় আদিবাসীদের বসবাসের ফলে তারা প্রতিনিয়ত সরকার কর্তৃক প্রদানকৃত ত্রাণ গ্রহণ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের দেশের কিছু এলাকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সাবান দিয়ে হাত ধোয়াটাও কঠিন একটি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে আদিবাসীদের অধিকারসমূহ প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে এই জাতীয় সংকটকালে তাদের সামাজিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা কতখানি সম্ভব হচ্ছে তা নিয়ে রয়েছে ঘোর সংশয়।
এদিকে, আদিবাসীদের কোভিড-১৯ প্রতিরোধে জাতি-গোষ্ঠি নির্বিশেষে সকলের সেবা, বিশেষ করে আদিবাসীদের সেবাদানের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করেছেন। জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল আন্তনীও গুতেরেস্ বলেন যে, কোভিড-১৯ মহামারী সকল মানব সংকটের উর্ধ্বে এবং তা প্রায় সকলকেই কম-বেশি প্রভাবিত করছে, তাই আদিবাসী সম্প্রদায়সহ সকল সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্যগত এবং সামাজিক সুরক্ষা-ব্যবস্থা নিশ্চিত করা একান্ত জরুরী। তাছাড়া, সরকারের পক্ষ থেকে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় আদিবাসীদের সম্পৃক্তটা এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত আবশ্যক। অন্যদিকে, ঋঅঙ (ঋড়ড়ফ ধহফ অমৎরপঁষঃঁৎধষ ঙৎমধহরুধঃরড়হ) অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এবং সশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ করোনাকালীন এবং করোনা পরবর্তী স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কমাতে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে আদিবাসী প্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবক এবং উদ্যোগীদের সম্পৃক্ত করার জন্য প্রতিটি দেশের সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন। যেন আদিবাসীরা নিজ ভাষায় তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যার কথা জানাতে পারে এবং সেইমত সেবা গ্রহণ করতে পারে। এই আন্তঃসাংস্কৃতিক সেবাদানের মাধ্যমে আদিবাসীদের নানাবিধ সমস্যার সমাধান এবং কোভিড -১৯ প্রতিরোধে স্থানীয়দের সেবাদানের আওতায় নিয়ে আসাই এর মূল লক্ষ্য। কাজেই, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে টেকসই উন্নয়ন ব্যহত হওয়া রুখতে সংস্কৃতি ও বৈষম্যের উর্ধ্বে গিয়ে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।
সর্বোপরি, কোভিড ১৯ একটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংকট যার নির্মম শিকার বিশ্বের আদিবাসী সম্প্রদায়সমূহ। এই সংকটকালীন এবং পরবর্তীতে আদিবাসীদের স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন এতটা সহজ হবে না। তাদের আর্থ-সামাজিক জীবনে যে চড়াই-উৎরাই সৃষ্টি হয়েছে, তা অন্যান্য কঠিন সময়ের মতই প্রতিহত করতে সক্ষম হবে বলে বিশ্বাস করি। ২০২০ খ্রিস্টাব্দের আদিবাসী দিবসে কোভিড-১৯ জয় এবং পরবর্তীতে সংগ্রামের দৃঢ় অঙ্গীকার লালন করে আদিবাসী জনগোষ্ঠি সম্ভাবনার পথে নির্ভয়ে এগিয়ে যাক মনে-প্রাণে সেই বাসনাই করি।
Tags:
সমাজ