জাসিন্তা আরেং : যখন বিশ্বময় করোনাভাইরাস তার বিভীষিতা মেলে ধরছে, তখন সেবিকারাও চিকিৎসকদের পাশাপাশি আপন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবিকারা সেবা দিয়েছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। এ পেশায় থেকে নিবেদিত সেবিকারা তাদের পরিবার, সন্তান-সন্ততিদের থেকে দূরে থেকে করোনা আক্রান্ত রোগিদের যে সেবাদান করে আসছেন তা অতুলনীয়। তাদের সেবা-যত্নের ফলেই অনেক মুমূর্ষ রোগি করোনাকে জয় করে স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন-যাপন করছেন। এমন অনেক সেবিকা রয়েছেন যারা রোগিদের সেবা করে নিজেই পরিবারসহ এ মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছেন ও নির্ভীক সৈনিকের মত লড়াই করেছেন। জরুরী এ অবস্থায় অনেক সেবিকাই জীবন বিপন্ন করে সেবার আলোকবর্তিকা হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন করোনা আক্রান্ত রোগিদের। এমনই দুজন সেবিকা ও তাদের সেবাদান এবং তিক্ত-মধুর অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে ‘জীবন ও সমাজ’ এর বিশেষ আয়োজন। আর এবারের আয়োজনে রয়েছেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স মিসেস মারিয়া গোমেজ ও ঢাকা বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার মিসেস প্রমিলা ডি’কস্তা। স্বল্প পরিসরে তাদের সাক্ষাৎকারে ফুটে ওঠেছে, করোনাকালীন করোনায় আক্রান্ত রোগিদের সেবা দিয়ে কারোনা রোগিদের সেবাদানের পেছনে তাদের অনুপ্রেরণা, ভাল লাগার মুহূর্ত এবং তাদের অভিজ্ঞতার কথা । করোনা মহামারী ছাড়াও অন্য কোন মহামারীকালীন সেবাদানের অভিজ্ঞতা, করোনা রোগিদের সেবার ক্ষেত্রে বাঁধাবিঘ্ন ও তা মোকাবিলার কথা ইত্যাদি। বিশেষভাবে, করোনাকালীন কর্মরত প্রতিষ্ঠান হতে সহায়তা ও পরিবারের সমর্থনের কথা দিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের ফিচার।
![]() |
ছবিতে বা থেকে মারীয়া গোমেজ ও প্রমীলা ডি’কস্তা |
মারিয়া গমেজ
সিনিয়র স্টাফ নার্স, জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম
দেশে যখন করোনার মহামারির আঘাত হানে তখন করোনা রোগিদের সেবা করার সুযোগ আমিও পাই। জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রামে করোনা রোগিদের জন্যে আইসোলেশন ওয়ার্ড খোলা হয়। আইসোলেশনে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগির শরীরের সেসেরেশন চেক করি। আর সেই অনুসারে তার অক্সিজেন বাড়িয়ে দেয়া, এছাড়াও রোগি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে এসেছে কিনা তা পরীক্ষা করা ইত্যাদি। এমনও সময় এসেছে যে, আমরা সেবাদানে ব্যস্ত থাকায় নিজেদের খাওয়া-দাওয়ার কথা ভুলে যেতাম। একজন আরেকজনের খোঁজ-খবর নেয়ার ফুসরত পেতাম না। এই মহামারি ছাড়াও দেশে যখন আরো বিভিন্ন মহামারি এসেছে যেমন ডেঙ্গু, ডায়রিয়া প্রভৃতির সময়ও সেবা করার সুযোগ হয়েছিল আমার। করোনাকালে আমার পরিবার আমাকে সমর্থন করেছে। বাড়িতে ছিল আমার দুই সন্তান এক মেয়ে ও এক ছেলে। এই সময় আমার মেয়ে ঘরের যত্ন নিয়েছে। ঘরের যাবতীয় কাজ করেছে। আমার জন্যে বিভিন্ন সময় খাবার তৈরি করে আমার জন্যে পাঠিয়েছে। আমার ছোট ছেলে জয় আমাকে প্রতিদিন জড়িয়ে ধরতে চাইতো কিন্তু পারতো না যা আমাকে খুব কষ্ট দিতো। আমার ছেলে প্রতিদিন আমাকে দেখতে আসত, কিন্তু কাছে আসতে পারত না বিধায় দূর থেকে দেখে চলে যেতো। আমার সহকর্মীরা আমাকে বলত, তোমার ছেলে এসেছিল তোমাকে দেখতে।
পরিবারের সদস্যদের কথা চিন্তা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্যে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে তাই আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। আমরা যারা করোনা রোগিদের সেবায় নিয়োজিত আছি, আমাদের কারণে যেন পরিবার ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তাছাড়া, আমাদের থাকা ও খাওয়ার কোন অসুবিধা হয়নি বরং কিছুটা স্বস্তিই পেয়েছি। আমি আমার এই সেবার পেশায় থাকতে পেরে গর্বিত। সর্বোপরি, মানুষদের সেবা করে মনে-প্রাণে এক ধরনের শান্তি অনুভব করি।
প্রমিলা ডি’কস্তা
নার্সিং সুপারভাইজার, শিশু হাসপাতাল, ঢাকা
বাংলাদেশে অন্যতম একটি হাসপাতাল শিশু হাসপাতাল। এটি ৬০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। দেশে যখন করোনার প্রাদূর্ভাব শুরু হয়, তখন আমাদের হাসপাতালে কিছু-কিছু রোগির আগমন ঘটে যাদের মধ্যে করোনার লক্ষণ পাওয়া যায়। এরপর তাদের যখন পরীক্ষা করে করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়, তখন আমাদের হাসপাতালে করোনার একটি ইউনিট খোলা হয়। আমরা সর্বদা প্রস্তুত থাকি রোগিদের তড়িৎ গতিতে সেবা দেয়ার জন্য। আমাদের হাসপাতালের ইমার্জেন্সি’র ব্যবস্থা অত্যন্ত ভাল। আর তাই তো এই হাসপাতালে বেশিরভাগ রোগি সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। আর যখন দেখি আমাদের অকৃত্রিম সেবাদানের ফলে একজন রোগি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন, তখন মনের মধ্যে এক ধরনের ভাল লাগা কাজ করে। আর ভাল লাগার এই অনুভূতি সত্যিকার অর্থে অন্যরকম। আমাদের প্রতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা ছিল অনুকূল। আমাদের নিরাপত্তার জন্যে সব রকম ব্যবস্থা করেছে হাসপাতাল। আর তাই তো করোনা মহামারিতে নিজের এই পেশাকে ভালবেসে এখনও মানুষের সেবা করে যাচ্ছি। আর এই সময় আমি আমার পরিবারের সদস্যদের যথেষ্ট সমর্থন পেয়েছি। আমার স্বামী ও সন্তানেরা বুঝতে পেরেছে এই সময় আমি তাদের বাড়তি যত্ন নিতে পারছি না। আর তারাও ঘরের বিভিন্ন কাজে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে এই পেশাকে আমি কিভাবে দেখি, আমি বলি মূলত আমি এটাকে পেশা হিসেবে দেখি না বরং সেবা হিবেবে দেখি। যখন দেখি আমার সেবা পেয়ে অনেক মুমূর্ষ রোগি সুস্থ হচ্ছে, তখন খুব ভাল লাগে। এই সেবারদায়িত্বে থেকে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট।
এমন হাজারো সেবিকা রয়েছে দেশে যারা অকুতোভয়ে করোনা রোগিদের সেবাদান করে যাচ্ছে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতেও পিছু পা হচ্ছে না। এমন নিবেদিতপ্রাণ সেবিকাদের জন্যই দেশের অনেক রোগি স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন যাপন করতে সক্ষম হচ্ছে। রোগিদের জীবন যেমন করে সেবিকাদের সেবায় নবজীবন শুরু করতে পাচ্ছে, তেমনি সেবিকাদের জীবনও ভরে উঠুক মানুষের ভালবাসা ও প্রার্থনায়। এ সেবাদায়িত্বে যারা নিয়োজিত রয়েছে, তাদের জন্য শুভকামনা ও আশীর্বাদীত জীবন প্রত্যাশা করি।
[জীবন ও সমাজে পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ]