পরন্তবেলার পথিক

রত্ন বাড়ৈ হাওলাদার : 

সেই--সেকালের কথা। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করে চাকুরিতে ঢুকে গেল। বছর খানেক পার হতে না হতেই বাবা বিয়ের জন্য তোড়জোর করে মেয়ে দেখতে শুরু করে দিল। অনেক দেখা-দেখি কিন্তু পছন্দ মনমতো হচ্ছিল না। মেয়েটি সুন্দরী, গায়ের রং ফর্সা, হাল্কা-পাতলা গড়ন। মোটামোটি লেখাপড়া শিখেছে। সেই আমলে শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলের মূল্য ছিল আকাশ ছোঁয়া। শান্তিবাবু, শানের বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন ক্রিস্টমাস সিজনে চার্চের প্রোগ্রামে তিনি মেয়ে খুঁজবেন। হয়তো সেখানে তাদের মনের মত একজন মেয়ে তারা পেয়ে যাবেন। কারণ ঐ সময়টিতে দেশ-বিদেশ থেকে আগত অতিথিদের আগমনে মিশন কম্পাউন্ড মুখরিত হয়ে ওঠে। সেকি আনন্দ! সবাই মিলে বড়দিন উৎসব উদ্যাপন করা। সন্ধ্যা থেকে বিভিন্ন পর্বে যোগদান করা। প্রভু যিশু খ্রিস্টকে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত করা। যেন অন্যরকম অনুভূতি। তাছাড়া বড়দিন উপলক্ষে প্রতিটি বাড়িতেই আত্মীয়স্বজনদের ভীড় থাকে। খাবার-দাবার পিঠা-পরমান্দতো চলতেই থাকে। নদীতে সাঁতার কাটা, পুকুরে মাছ ধরা ও রাতভর চড়ুইভাতির মহরা আরো কত কি! এই আনন্দ যেন স্বল্প ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। এক অন্যরকম অনুভূতি। সত্যিই স্মৃতি বড় বেদনাদায়ক। 

শান্তবাবুর যে কথা সেই কাজ। একজন মেয়ে যেন চোখের অন্তরালে খুঁটি পুঁতে দিল। এরপর কথাবার্তা, নিয়ম-কানুনের ঝট্-ঝামেলা যা আছে সবকিছু মিটিয়ে জানুয়ারিতে দিন-ক্ষণ পাকা হয়ে গেল। কারণ খ্রিস্টমণ্ডলীর আইন অনুসারে উপবাসকাল ও আগমনকালে কখনও কাউকে বিবাহ সংস্কার প্রদান করা হয় না। পুরোহিতগণ কিছু নির্দিষ্ট সময়টিতে বিবাহ সাক্রামেন্ত প্রদান করেন না। সাময়িকভাবে বিবাহ সংস্কার বন্ধ রাখেন। অবশ্য নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে থাকা ভালো। যেন অধ্যবসায়ী হওয়ার অভ্যাসটি বিলুপ্ত না হয়ে যায়। 

অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। সব শুভকাজ সফল ও সুন্দরভাবে সমাপ্ত হলো। জীবন তার নিজ গতিপথে চলতে লাগল। আজ তাদের সুখের সংসারে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে-মেয়েরা উচ্চশিক্ষা লাভ করে ভালো চাকুরি করছে। প্রত্যেকের বিয়ে-সাদির সমাপ্তি ঘটিয়ে একটুখানি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন বাবা শানবাবু এবং মা সারথি। দায়িত্বসকল চুকিয়ে এখন কিছুটা হাল্কা ও বিড়ম্বনাহীন জীবন যাপন করছেন।

এরপর তারা সিদ্ধান্ত নিলেন; অবসরে জীবনে তারা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকবেন। বাড়িটা অবশ্য মফস্বলে হলেও স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, চার্চ এবং হাঁট-বাজার সব কিছুই হাতের নাগালে ছিল। সুযোগ-সুবিধার কোনো কমতি ছিল না। অবসরে সময় কাটানোর  মনোরম পরিবেশ ছিল সেই গ্রামীণ বাড়িতেই। যেমনটা ভাবল, তেমনটাই করল। তারা সেই ছোটবেলার স্মৃতি বিজড়িত অম্ল-মধুর স্বাদ আস্বাদনে ফিরে গেলেন তাদের দেশের বাড়িতে। সেই গাছের ছায়া ও লতা-পাতায় উদাসী বনের বায়। ওখানে তারা ধর্মীয় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদেরকে জড়িয়ে রেখে আধ্যাত্মিক কাজের মধ্যদিয়ে সকলের সঙ্গে মিলে-মিশে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে লাগলেন। কথায় বলে সুখের পরে নাকি দুঃখের নিশানা। এছাড়া গানেও এই বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে এভাবে-সুখের পরে দুঃখ আসে, সুখ থাকে না চিরদিন। সত্যিই তাই, হঠাৎ করে বড় ছেলের চাকুরিচ্যুতি হওয়ায় তাকেও সেই গ্রামের বাড়িতে ফিরে যেতে হলো এবং বাবার কিছুটা জমানো পুঁজি নিয়ে ওখানেই ছোটখাট একটি ব্যবসার কাজে নেমে পড়তে হলো। সন্তান দুজনকে বর্ডিং হোস্টেলে রেখে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে লাগল। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে মোটামোটি ভালোই আছে।এদিকে বাবা-মা বাড়িতে রয়েছেন। মাঝে-মধ্যে অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের বাড়িতে বেড়াতে যান। দুজনের মধ্যে ভীষণ আন্তরিকতা ও ভীষণ মিল যেন একই আত্মার বন্ধনে বাঁধা পড়ে আছে। যেন একটি আদর্শ জুটি।



শানবাবুর স্ত্রী সর্বদা বলতেন এবং চিন্তা করতেন সৃষ্টিকর্তা যেন তাদের দুজনকে এই পৃথিবী থেকে একই সঙ্গে তাঁর কাছে ডেকে নেন। কারণ স্ত্রী সারথী তার স্বামীকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা করতেন। অনুভূতিতে সর্বদা উপলব্ধি করতেন তিনি যদি স্বামীর আগে চলে যান... তবে তার স্বামী অর্থাৎ শানবাবুকে দুর্বিপাকে পড়তে হবে। সত্যি বলতে কি তিনিই শুধু নন পরন্তবেলায় এসে সব বিপত্নীক পুরুষেরাই এই মর্মান্তিক ও দুর্ভাগ্যজনক একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে থাকেন। কেননা পুরুষ মানুষেরা সর্বদা একটু হিসেব-নিকেশ করে চলার চেষ্টা করেন। নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে পছন্দ করেন। একটু ঝামেলামুক্ত থাকতে চান। একজন মেয়ে মানুষ যে ব্যাপারটি অতি সহজেই মানিয়ে নিতে বা মোকাবিলা করতে পারে, তা একজন পুরুষ মানুষের ক্ষেত্রে সেটি করতে পারাটা তুলনামূলকভাবে কঠিনই বটে। কেননা সৃষ্টিকর্তা নারীদের সেসব গুণাবলি দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে কোন স্থানে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় তথা ক্ষুধা, তাপ, দুঃখ, ব্যাথা-বেদনা সহ্য করা ও তা কাটিয়ে উঠার এই সক্ষমতা হলো নারীদের প্রতি ঈশ্বরের দান ও বিশেষ অনুগ্রহ। সহজভাবে মানিয়ে নিয়ে জীবনের কন্টকাকির্ণ পথে চলা ও সংগ্রাম করা যেন সব নারীরই চিরায়ত ধর্ম।

মূলত, একজন পুরুষ মানুষের পক্ষে হুট-হাট করে কিছু বলা বা করা দূরুহ ব্যাপার। তাছাড়া একজন মেয়ে, পুত্রবধূ বা পরিচারিকার পক্ষে অসুস্থ মাকে নাওয়ানো-খাওয়ানো, সেবা-শুশ্রুষার দায়িত্ব গ্রহণ ও পালন করা যতখানি সহজ, একজন বাবার পক্ষে তা মোটেও সহজসাধ্য নয়। বিশেষ করে যদি হয় তা আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে। সঙ্গত কারণেই জীবনের পরন্তবেলায় একজন বিপত্নীক স্বামীকে দুর্ভোগ পোহাতে হয় যা তারা উপলব্ধি করে যখন তারা বার্ধক্যের ঘরে পদার্পণ করে। যেন আধমরা হয়ে বাঁচা। বেঁচে থেকেও মরার মত অবস্থা জীবন স্বায়হ্নে এসে...আর সেই কারণে মনের গহীনে তার স্ত্রীর একটাই চিন্তা যেন কুঁড়ে-কুঁড়ে খায়। চিন্তায় পড়ে যায় তার স্বামীকে নিয়ে। তাই হয়তো শত দুঃখ-বেদনার মধ্যেও ঐ একটি ভাবনা প্রবাহিত হয়। কারণ কে না চায় শাঁখা-সিন্দুর অক্ষয় রেখে ভাগ্যবতীরূপে শায়িত হতে। নাকফুল সঙ্গে নিয়েই তারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চায়। কিন্তু জন্ম-মৃত্যু যে স্বয়ং বিধাতার হাতে। এ ব্যবস্থার যেন কোন বিকল্প নেই। কার ডাক যে কখন আসবে কেউ জানে না। কেউ কখনও বলতে পারে না। কাজেই হৃদয় বিদারক হলেও সত্যকে তো মেনে নিতেই হবে। 

এভাবেই অনেক বছর কেটে গেল। আসলে সময় এবং বয়স যেন কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সুতরাং মানুষ যতই বিত্তশালী বা বিত্তবান হোক না কেন, মৃত্যুর কাছে তাকে মাথা নত করতেই হবে। হার মানতেই হবে। এই বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কারো সাধ্য নেই। ক্যালেন্ডারের একটি তারিখ যে তাকে বহন করতেই হবে। সেই বাস্তবতাকে গ্রহণ করেই হঠাৎ একদিন শানবাবুর স্ত্রীও তাকে ছেড়ে, মাথার সিঁন্দুর অক্ষয় রেখে ভাগ্যবতীর বেশে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেল। নিজের অন্তরের গহীনে আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত অগ্নিকে প্রজ্বলিত রেখেই তাকে চলে যেতে হল না ফেরার দেশে। অপূর্ণ ইচ্ছা হৃদয়ে পুঞ্জিভূত করে চলে যেতে হলো তাকে।

তখন থেকেই শানবাবু একাকী জীবন-যাপন করছেন। দিনের পরদিন বয়সের ভারে নুয়ে পড়তে লাগলেন। নিজের সাধ্য-সামর্থ হারিয়ে ফেলতে লাগলেন। অন্যের বোঝার বলে নিজের মান-সম্মানকে আত্মহুতি দিচ্ছেন। তিনি বড্ড ব্যাকুল থাকতেন। তিনি জীবনভর আপন ভাব-গাম্ভীর্যতা তথা শিরদাঁড় করে চলেছেন। কিন্তু আজ তার অবস্থান একটি জীর্ণ-শীর্ণ কুটিরে। 

হৃদয় বিদারক হলেও এটাই বাস্তবতা। আজ শানবাবু শক্তি-সামর্থহীন একজন পিতা। নিজে কোন কিছু করার ক্ষমতা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। যেন অকেজো একজন বৃদ্ধ। তাই সেই দোষে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে খাদ্যদানে যথেষ্ট কৃপণতা ছিল। এমনকি শুশ্রুষাকারীর অভাবে ময়লা-সম্বলিত বিছানাই ছিল তার খাবার ঘর, শোবার ঘর এবং টয়লেট, বলা যায় তার সকল কাজের  কেন্দ্রস্থল। দূর্গন্ধের কারণে কোন প্রাণী তার কাছে ভিড়তে পারছিল না। অতীতে যিনি ছিলেন দেবতার ন্যায়, ভীষণ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তার স্পর্শকাতর পরিস্থিতি মর্মস্পর্শী করে তুলছে সকলকে। কিন্তু নীরব দর্শক হয়ে অবলোকন করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। 

হয়তো মাসে একবার বৃদ্ধ লোকটির ছেলে নাকে গামছা পেচিয়ে, নলকূপের খোলা ট্যাবের ঠান্ডা পানির নীচে বৃদ্ধ বাবার পিঠে শুকিয়ে যাওয়া (দুদু), “শলার ঝাড়ু” দিয়ে ঘষে-ঘষে তুলছে। কখনো হয়তো আটকে যাওয়া (দুদু) ময়লা ঘষে তুলতে গিয়ে ছেলের পা উঠে  যেত অসহায় বৃদ্ধ বাবার পিঠের উপরে। কখনো ফুলে যেত পিঠের অংশ বিশেষ। আবার কখনো দর-দর করে রক্ত ঝরত চামড়া খসা ওই পিঠ থেকে। শীতের ভারে ঠক্-ঠক্ করে কাঁপতেন। ছেলেকে দেখে বাবা কোথায় আনন্দে আত্মহারা হবেন তা নয় বরং তিনি অশ্রুজলে ভাসতেন আর ভয়ে ঠক্-ঠক্ করে কাঁপতেন। এরকম একটি দৃশ্য কল্পনা করলেই যেন গা শিহরে ওঠে। তবে এটাই জীবন। যাদের জন্য বাবা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে; মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সন্তানদের একটুখানি ভালো রাখার সুবাদে কতো কষ্টভোগই না করেছেন। কতো আত্মত্যাগই না করেছেন! আসলে এসব কিছু চিন্তা করেই বোধহয় স্ত্রীরা চায় সৃষ্টিকর্তা যেন তাদের এক সঙ্গে পৃথিবী  থেকে তুলে নিয়ে যান। বৃদ্ধ বয়সে স্বামীর অসহনীয় কষ্টের পরিসীমা যেন তারা আগেই উপলব্ধি করতে পারেন, যা অন্য কারো  বোধগম্য নয়। তারা না পারেন কাউকে কিছু বলতে, আর না পারেন কিছু করতে। কঠিন এক বেড়াজালে বাঁধা পড়ে যান। শুধুমাত্র মৃত্যুর দিন গোনতে থাকেন একজন ক্যান্সার রোগীর মত। “ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডণ।” সবকিছু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা। তবে ভুলে গেলে চলবে না, আমরা সকলেই যে--ঐ একই পথের পথিক। ঠিকানাটাও অন্যত্র নয়। আর সেটাই সৃষ্টির রহস্য।

ভাবার বিষয় এই যে, বাবা-মা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি যেখানে পরম শ্রদ্ধার পাত্র। সৃষ্টিকর্তার পরেই যেখানে তাদের স্থান। বাবা-মায়ের পায়ের নীচেই সন্তানের স্বর্গ বা বেহেস্ত। কিন্তু সেখানে রয়েছে শুধু অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা ও অপমান। প্রকৃতপক্ষে, স্বভাব পরিবর্তন করা একটু দুরূহই বটে। কিন্তু অভ্যাস তো পরিবর্তনশীল। আর মানুষ তো অভ্যাসেরই দাস। 

[  জীবন ও সমাজে  পাঠাতে পারেন আপনার অর্থপূর্ণ লেখা। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ]

Post a Comment

Previous Post Next Post